আরজে কিবরিয়া। পুরো নাম মো. গোলাম কিবরিয়া সরকার। কখনো জীবন গল্প, কখনো সিক্রেটস, যাহা বলিব সত্য বলিব, লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড, আপন ঠিকানাসহ কয়েকটি অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় নিজের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। পেয়েছেন দেশব্যাপী জনপ্রিয়তাও। সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। কথা বলেছেন নিজের নানা অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনা নিয়ে।

করোনাকালে কেমন চলছে কাজ?

আরজে কিবরিয়া : করোনাকালে অফিসের কাজ খুব একটা চলছে না। আসলে আমরা আগেভাগে অনেক অনুষ্ঠান রেকর্ড করে রেখেছিলাম। এখন সেগুলোর এডিটিংয়ের কাজ চলছে। তাই রেডিও এবং অনলাইনে কন্টেন্ট নিয়ে নিয়মিত কাজ করছি।

এমন পরিস্থিতিতেও কীভাবে কাজ করে যাচ্ছেন?

আরজে কিবরিয়া : কাজ করাটা খুব কঠিন। এখন আসলে ভিডিও এডিট করছি। নতুন করে খুব একটা ইন্টারভিউ নিচ্ছি না। একেবারেই নিচ্ছি না বললেও চলে। কারণ আমরা সবাই লকডাউন মেনে চলার চেষ্টা করছি। জরুরি না হলে সাধারণত অফিসে যাওয়া হয় না।

মো. গোলাম কিবরিয়া সরকার থেকে আরজে কিবরিয়া হয়ে ওঠার গল্পটা জানতে চাই-

আরজে কিবরিয়া : ইউনিভার্সিটিতে ডিবেট করতাম। তখনই দেশে প্রথমবারের মত রেডিও টুডে চালু হয়। সেখানে রুটি-রুজির জন্যই কাজ শুরু করি। যদিও রেডিওতেই যে কাজ করব, সেটা কখনো কল্পনাতেও ছিল না। কিন্তু করতে করতে এক রকম প্রেমে পড়ে গেলাম। তারপরে ধারাবাহিকভাবে একটার পর একটার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছি। দেখতে দেখতে রেডিওতে ১৬ বছর আর টেলিভিশনে ১০ বছর কাজের বয়স হয়ে গেছে। এখন স্টুডিও অব ক্রিয়েটিভ আর্টস লিমিটেড নামে নিজের একটি প্রতিষ্ঠান গড়েছি। এখান থেকে সোশ্যাল মিডিয়া কন্টেন্ট তৈরি করছি। মাঝে সাড়ে তিন বছরের মতো ইউল্যাবে পড়িয়েছিলাম, সেটাও রেডিও নিয়ে। 

এখন কোথায় কাজ চলছে?

আরজে কিবরিয়া : বর্তমানে আমি কাজ করছি মাছরাঙা টেলিভিশনে, পাশাপাশি ঢাকা এফএমের সঙ্গেও যুক্ত আছি। এছাড়া আমার সবচেয়ে বেশি সময় কাটে স্টুডিও অব ক্রিয়েটিভ আর্টস লিমিটেডে।

জীবনে কী হওয়ার ইচ্ছে ছিল? কোন জায়গাতে নিজেকে দেখতে চেয়েছিলেন?

আরজে কিবরিয়া :  বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আরজে হয়ে গেলাম। তবে জীবনে একজন মেন্টর পেলে, শিক্ষক কিংবা ডাক্তার হতাম।

হারিয়ে যাওয়া মানুষকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার চিন্তা কীভাবে মাথায় এলো?

আরজে কিবরিয়া : হারিয়ে যাওয়া মানুষকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার চিন্তা আসে অনেকটা কাকতালীয় ভাবে। জীবনের গল্প নামের একটি অনুষ্ঠান করতাম রেডিওতে। ঢাকা এফএমে অনুষ্ঠানটা হতো। সেখানে একদিন তাসলিমা নামের এক ভদ্র মহিলা আমাদের কাছে এসেছিলেন। তিনি তার জীবনের গল্প বলতে চান। এরপর তিনি নিজের গল্পটা আমাদের বললেন। আমি সে গল্প অডিও ভিডিও করে আমার পেইজে আপলোড করি। ক্যাপশন দেই, দেখেনতো ভদ্র মহিলাকে চেনা যায় কিনা? কোন এক নায়িকার সঙ্গে তাসলিমার চেহারার খুব মিল ছিল। আমাদের খুব পরিচিত একজন নায়িকা। মানুষজন নায়িকা মনে করেই ঢুকেছে এবং ২ ঘণ্টার মধ্যে পরিবারের সন্ধান পেয়ে যাই। সেটা আমার কাছে খুবই অবিশ্বাস্য ছিল। 

তখন আমি বেশ কিছু মেইল পাই এবং তাদেরকে নিয়ে নিয়মিত কাজ করতে থাকি। একের পর এক সফল হতে থাকি। এ থেকেই জন্ম হয় লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডের। লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড মূলত আরজে কিবরিয়া পেইজেই কাজটা হতো। যেহেতু ঢাকা এফএমের অনুষ্ঠান থেকে এ কনসেপ্টটা পাওয়া, তাই আমি চেষ্টা করেছি ঢাকা এফএমকেও রাখার জন্যে। আমরা প্রায় ৩১টি এপিসোড সফলভাবে সম্পন্ন করি। যদিও প্রচার হয়েছে আরো অনেক বেশি। বলতে পারি, ৩১টি পরিবার হারা সন্তানকে আমরা পরিবারে ফিরিয়ে দিয়েছি।

'লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড' ও 'আপন ঠিকানা' এ দু'টি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আপনি হারিয়ে যাওয়া মানুষকে পরিবারের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। এ পর্যন্ত কতটি শো করেছিলেন, কতজন মানুষ তার পরিবারকে ফিরে পেল?

আরজে কিবরিয়া : লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ড অনুষ্ঠান ছিল মূলত আরজে কিবরিয়া এবং ঢাকা এফএমের একটি যৌথ উদ্যোগ। কিন্তু আপন ঠিকানা হচ্ছে একেবারে স্টুডিও অব ক্রিয়েটিভ আর্টস লিমিটেডের উদ্যোগ এবং এটা বলা চলে মূলত একই কনসেপ্ট, একই চিন্তা।  কলেবরটা অন্য রকম। আপন ঠিকানা আর লস্ট অ্যান্ড ফাউন্ডে সফলতার সংখ্যা ৬০। মানে ৬০টা পরিবারে আমরা হারানো সন্তান ফিরিয়ে দিয়েছি। এ বছরের মধ্যে আমরা শ'খানেক, হারানো সন্তানকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারবো আশাকরি।

প্রতিবেদকের সঙ্গে আরজে কিবরিয়া

হারানো মানুষটির পরিবারের পরিচয় নিশ্চিতের জন্য কী কী বিষয়কে গুরুত্ব দেন?

আরজে কিবরিয়া : আমরা স্টোরি বেসিসে কাজ করি। তাই তথ্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। মিনিমাম লেভেলের কিছু তথ্য, কখনো কখনো শরীরের দাগ বা ডিএনএ ও লিগ্যাল যে প্রসিডিউরগুলো আছে সেগুলো মেইনটেইন করার জন্য দুই পক্ষকে উৎসাহিত করি। এরপর নিশ্চিত হই হারিয়ে যাওয়া মানুষটির পরিবার এটি কিনা।

মানুষের কাছ থেকে কেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন?

আরজে কিবরিয়া : মানুষের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছি বলেই এ অনুষ্ঠানটা এখনো হচ্ছে। বলতে চাই, মানুষ এ অনুষ্ঠানকে যে পরিমাণের ভালোবাসা দিয়েছে, যে পরিমাণের সম্মান দিয়েছে তা সত্যিই বিরল। সে জায়গা থেকে আমি বলবো, এটা মানুষের প্রাণের অনুষ্ঠান, ভালোবাসার অনুষ্ঠান, অন্তরের অনুষ্ঠান। মানুষের সাপোর্টই বেশি পেয়েছি।

তবে একটা প্রতিবন্ধকতার জায়গা আছে। সেটা হলো ডিএনএ টেস্ট। স্টুডিও অব ক্রিয়েটিভ আর্টস লিমিটেড নিজের জায়গা থেকে এখনো পর্যন্ত সে রকম কোন ব্যবস্থা করতে পারেনি। তবে আমরা স্বপ্ন দেখছি, আমাদের নিজের একটা প্রাইভেট ল্যাব হবে ভবিষ্যতে।

রেডিও নাকি টেলিভিশন কোন মাধ্যমে কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

আরজে কিবরিয়া : রেডিও টেলিভিশনের মধ্যে অবশ্যই রেডিওকে বেছে নেব। কারণ, রেডিওটা হচ্ছে, আমরা স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গাটা। রেডিওতে আমি নিজের মত করে ড্রাইভ করি। টেলিভিশন অনেকটা স্ট্রাকচারাল ওয়ার্ক। কিন্তু টেলিভিশনে কাজ করেও অনেক কিছু শিখেছি। তাছাড়া আমি আমি কনটেন্ট মেকিং করছি সোশ্যাল মিডিয়াতে। এটাও আমার ভালো লাগার একটি কাজ।

কোন কোন অনুষ্ঠান করে শ্রোতা ও দর্শকদের মন জয় করতে পেরেছেন?

আরজে কিবরিয়া :  দুইটা অনুষ্ঠান মানুষের মনে হয়তো অনেক দিন গেঁথে থাকবে। বিশেষ করে Hello 8920 অনুষ্ঠানটির কথা বলতে চাই। যেটা পরবর্তীতে জীবন গল্প নামে অনেকেই চিনেছে। আমি মানুষের জীবন নিয়ে যত ধরণের অনুষ্ঠান করেছি, তার সবগুলো ধারণা এসেছে এই Hello 8920 থেকে। এছাড়াও এবিসি রেডিওর হ্যালো ৮৯২০, ঢাকা এফএম এবং আরজে কিবরিয়ার লষ্ট এন্ড ফাউন্ড এবং স্টুডিও অব ক্রিয়েটিভ আর্টস এর আপন ঠিকানা এর কথাও বলতে চাই। কারণ এই অনুষ্ঠানগুলো করেছি বলেই মানুষের জীবন নিয়ে জেনেছি।

আপনার কাজে সব সময়ই নতুনত্ব দেখা যায়। এই নতুনত্বের পেছনে আসলে কোন জিনিসটা কাজ করে?

আরজে কিবরিয়া : নতুনত্ব আছে কিনা জানি না। তবে একটা জিনিস সব সময় বুঝি, দর্শকের চাহিদা মতো তাদের কাছে পৌঁছানোটাই আমার লক্ষ্য। সব সময় চেষ্টা করেছি দশজন মানুষের কাছে যদি আমার কন্টেন্ট যায়, তাহলে কমপক্ষে আটজন মানুষ যেনো আমার কনটেন্টটা দেখে। 

নতুন কোনো অনুষ্ঠানের কথা ভাবছেন কিনা?

আরজে কিবরিয়া : এখন অনলাইন কন্টেন্ট নিয়েই সবচেয়ে বেশি ভাবছি। চেষ্টা করছি নতুন নতুন কন্টেন্ট নিয়ে কাজ করার। অনলাইনে নিজস্ব প্লাটফর্ম হোক বা ওটিটি প্লাটফর্মে হোক, সেগুলো নিয়ে ভবিষ্যতে হয়তো আমরা কাজ করব। আর দুই নাম্বার হচ্ছে, আমার নিজের একটা ক্যারিয়ার করার চিন্তা আছে, ফার্মিংয়ের উপরে। যেটা হয়তো আমার কিছু দর্শক জানে। জীবনের একটা পর্যায়ে গিয়ে আমি কৃষিতে সময় ব্যয় করতে চাই। অবশ্য সেটা এখনো শুরু করা হয় নাই।

অনেকেই স্বপ্ন দেখেন আরজে কিবরিয়া হবার। সে স্বপ্নবানদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?

আরজে কিবরিয়া : হা হা, জানি না এমন কেউ স্বপ্ন দেখে কিনা! আমি আসলে ওই রকম কেউ না। আমি খুবই সাধারণ একজন। মানুষ আসলে সাধারণ হওয়ার স্বপ্ন দেখেন না। তবে স্বপ্ন বাজদের উদ্দেশ্যে বলব, যে যা কিছুই করুক না কেন, পারফর্মার যদি হতে হয়, তাহলে যাদের জন্য পারফরম্যান্স করবে, তাদেরকে বোঝাটা জরুরি। তারা কী দেখতে চায়, সে বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে। একটা কন্টেন্ট যখন তৈরি হয়, কন্টেন্টের ইউনিকনেসটা কী, ইন্টারেস্টিং লাইন আপটা কী সেটা বোঝা খুবই জরুরি। 

এএ