উপস্থাপনায় চেহারার চেয়ে কথা বলার অঙ্গভঙ্গি বেশি গুরুত্বপূর্ণ
ফারাবী হাফিজ। সংবাদ উপস্থাপক ও বিশ্লেষক। গতানুগতিক সংবাদ উপস্থাপনাকে পাশ কাটিয়ে নিজস্ব ঢংয়ে হয়েছেন দর্শকপ্রিয়। সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। শুনিয়েছেন সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে কাজের সুযোগ, নিয়োগ প্রক্রিয়া ও আয়-রোজগারের আদ্যোপান্ত।
ঢাকা পোস্ট : সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে ফারাবী হাফিজ পরিচিত মুখ। সাধারণ মানুষ তো বটেই, তরুণ সংবাদকর্মীদের মাঝেও আপনাকে নিয়ে আগ্রহের কমতি নেই। স্বাভাবিকভাবেই আপনার সম্পর্কে অনেক কিছু জানার আছে। তবে শুরুটা হোক শুরুর গল্প দিয়েই-
বিজ্ঞাপন
ফারাবী হাফিজ : আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র। সাংবাদিকতা করবো তখন থেকেই মোটামুটি নিশ্চিত। তবে সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে কাজ করবো, বিষয়টি তখনো মাথায় আসেনি। ক্যারিয়ারের শুরু হয়েছিল রিপোর্টার হিসেবে। একাধিক বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছি। মূলত সংবাদের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়েছে রিপোর্টিংয়ের সময় থেকেই। সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে কাজের শুরু হয় আরও কিছুদিন পরে। সময় টেলিভিশনের হাত ধরে।
ঢাকা পোস্ট : সেই অর্থে সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে হাতেখড়ি সময় টেলিভিশনে?
ফারাবী হাফিজ : অনেকটা এমনই। একটা মজার ঘটনা বলি। সময় টেলিভিশন যখন যাত্রা শুরু করে তখন আমি দেশ টিভিতে। দেশ টিভি থেকেই আমরা সময় টেলিভিশনে যোগ দেই। সে সময় ভারত থেকে অপর্ণা নামের একজন আসেন। তিনি মূলত আমাদের যাচাই বাছাইয়ের জন্য নিযুক্ত ছিলেন।
আরও পড়ুন : নবযাত্রার সারথি হোন আপনিও
সময় টিভিতে তখনো সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে আলাদা কোনো পদ ছিল না। রিপোর্টারদের পর্যায়ক্রমে সংবাদ উপস্থাপনা করতে হতো। স্বাভাবিকভাবে আমার উপরেও সেই দায়িত্ব পড়ে। তো একদিন অপর্ণা দি আমাকে ডেকে বললেন, ‘ফারাবী আপনার ভ্রু প্ল্যাক করতে হবে। আপনি কালই পার্লারে যাবেন।’ এ কথা শোনার পর আমার মন খুব ভেঙ্গে গেলো। আমি মফস্বল শহরে বড় হয়েছি। পার্লার-টার্লার আমার কাছে বড়লোকদের ব্যাপার মনে হতো। সত্যি বলতে আমি এসবের সঙ্গে অতোটা ‘ইউজটু’ না।
পরদিন একজন সহকর্মীকে বললাম, ‘ভাই আমাকে দিয়ে উপস্থাপনা হবে না। আমি পার্লারে যেতে পারবো না। পার্লারে যাবে মেয়েরা। আমি কেন যাবো?’ এটা শোনার পরে অফিসে আমাকে নিয়ে রীতিমত হাসাহাসি পড়ে যায়। পরে বুঝতে পারি, অপর্ণা দি আমার সঙ্গে মজা করেছেন।
ঢাকা পোস্ট : আপনি যে সময়ে সংবাদ উপস্থাপনায় এসেছেন, তখন বা তারও আগে দেশে সংবাদ উপস্থাপনার একটি ধারা প্রচলন ছিল। অনেকটা ‘এলাম পড়লাম আর চলে গেলাম’ ধরনের। আপনি গতানুগতিক এই ধারা থেকে বের হয়ে এলেন কেনো? নতুনত্ব আনতে চেয়েছেন?
ফারাবী হাফিজ : আমি আসলে কোনো ধরনের মধ্যে যেতে চাইনি। নিজের মতো করে সংবাদ পড়তে চেয়েছি। সত্যি বলতে, সারাদিন রিপোর্টিংয়ের কাজ সেরে অফিসে এসে কাঠখোট্টা হয়ে সংবাদ পড়তে ইচ্ছা করতো না। তাই নিজের মতো করে পড়ার চেষ্টা করেছি।
একটু খোলাসা করে বলি, আমি নরমালি কারো সঙ্গে বলার সময়ে আমার হাত নড়ে। পুরো শরীর নড়ে। একটু আয়েশ করে বসে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। ঠিক এই কাজই আমি সংবাদ উপস্থাপনার সময়ে করেছি। বিষয়টি আদতে উপভোগ করতে চেয়েছি। এখনও করছি। তাই হয়তো আমার পড়ার স্টাইল অন্য সবার মতো না। আমার মতই।
ঢাকা পোস্ট : আর যাইহোক, আপনার নিজস্ব এই ঢং কাজে লেগেছে। সাধারণ মানুষ এক কথায় লুফে নিয়েছে।
ফারাবী হাফিজ : আপনাকে মানতেই হবে, টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ একজন উপস্থাপকের মাধ্যমে তার সংবাদগুলো সেল করে। একজন উপস্থাপকের উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। সামান্য একটি ভুল, কিংবা গতানুগতিক ধারায় সংবাদ পড়লে মানুষ পছন্দ করবে না। দ্রুতই চ্যানেল পরিবর্তন করবে। চ্যানেলের টিআরপিও কমবে। কার্যতই সংবাদ উপস্থাপককে দর্শক ধরে রাখার মতো দায়িত্বশীল হতে হবে। দর্শকের ঘরের মানুষ হতে হবে। যাতে দর্শক তার ড্রয়িং রুমে বসে আপনার কথা শুনতে চায়। আপনাকে বিশ্বাস করে। আমি এ কাজগুলোই করে আসছি। শুরু থেকেই অনেক ইতিবাচক সাড়া পাচ্ছি।
আরও পড়ুন : প্রত্যাশা বেশি বলেই সমালোচনা বেশি
ঢাকা পোস্ট : দীর্ঘদিন ধরে এ পেশায় যুক্ত আছেন। ইন্ডাস্ট্রির অনেক ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়ে আপনার নখদর্পণে থাকবে নিশ্চয়ই। একটা কানকথা বেশ প্রচলিত আছে, সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে ছেলেদের থেকে মেয়েদের সুযোগ বেশি। এটা কতটা সত্য?
ফারাবী হাফিজ : কিছু কিছু ক্ষেত্রে সত্য। তবে পুরোটা নয়। দিন শেষে আপনি ছেলে না মেয়ে, তার থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে যোগ্যতা। কথা বলার ধরন, সংবাদ সম্পর্কে ধারণা, পেশার প্রতি ভালোবাসা। আপনার সংবাদ উপস্থাপনা যদি আকর্ষণীয় হয়, দর্শক ধরে রাখার মতো হয়-তবে আপনাকে চ্যানেল ঠিকই রেখে দেবে। তবে পর্দায় সবাই চায় সুশ্রী দেখতে। এ ক্ষেত্রে মেয়েরাই এগিয়ে থাকে। ফলে তাদের অগ্রাধিকারও বেশি থাকে।
ঢাকা পোস্ট : তাহলে আগে দর্শনধারী পরে গুণ বিচারি, প্রবাদটি একেবারেই ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
ফারাবী হাফিজ : আগেই বলেছি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি সত্য। একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। এসব ক্ষেত্রে যোগ্যতাই মূল বিবেচ্য বিষয়। উপস্থাপনায় কখনো কখনো চেহারার চেয়ে কথা বলার অঙ্গভঙ্গি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আরও পড়ুন : গণমাধ্যম আইন : নিশ্চিত হোক মর্যাদা, অধিকার, নিরাপত্তা ও সুরক্ষা
ঢাকা পোস্ট : ঢাকা পোস্ট জবসের অন্যতম কাজ হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজের সুযোগ, নিয়োগ প্রক্রিয়া ও ক্যারিয়ার সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো মানুষের সামনে তুলে ধরা। সংবাদ উপস্থাপনা বর্তমানে অনেক চাহিদা সম্পন্ন একটি আধুনিক পেশা। তরুণদের মাঝে এই পেশা নিয়ে তুমুল আগ্রহ রয়েছে। কেউ যদি এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হতে চায়, কীভাবে হবে?
ফারাবী হাফিজ : চ্যানেলগুলো সাধারণত তিন ধরনের সংবাদ উপস্থাপক নেয়। খণ্ডকালীন, স্টাফ রিপোর্টার ও উপস্থাপক এবং ফুলটাইম উপস্থাপক। যারা ফুলটাইম উপস্থাপক তারা চ্যানেলের নিউজরুমেও কাজ করেন। আমি সবসময় একটা কথা বলি। সেটা হলে, যারা শুদ্ধ ভাবে বাংলায় কথা বলতে পারে, দেখে পড়তে পারে তারাই সংবাদ উপস্থাপনা করতে পারবে। এ জন্য আগ্রহীদের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে সিভি জমা দিতে হবে। চ্যানেলগুলো বিভিন্ন সময়ে অডিশন নেয়। এসব অডিশনে অংশ নিতে হবে। সেখানে ভালো করলে উপস্থাপক হিসেবে কাজের সুযোগ পাওয়া যাবে।
ঢাকা পোস্ট : মাঝেমধ্যে অনেকই অভিযোগ করেন, টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সংবাদ উপস্থাপকের জন্য আলাদা করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেয় না। দিলেও কালেভদ্রে। এ ক্ষেত্রে করণীয় কী?
ফারাবী হাফিজ : ধরেন একটা চ্যানেলে একজন উপস্থাপক লাগবে। তারা নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিল, সিভি জমা পড়লো পাঁচ হাজার। এখন এতো সিভি বাছাই করার জন্য পর্যাপ্ত লোকবল চ্যানেলে থাকতে হবে তো? অনেক সময়ে মানবসম্পদ বিভাগে পর্যাপ্ত সংখ্যক লোকবল থাকে না। ফলে এসব সিভি আর দেখা হয় না। নতুন করে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। তবে আমার পরামর্শ থাকবে, যারা এই পেশায় আগ্রহী তারা সব চ্যানেলের এইচআর বিভাগে নিজের ভালো একটি সিভি জমা দিয়ে রাখবেন। সঙ্গে ফোরআর সাইজের দুইটি ছবিও যুক্ত করবেন। এসব সিভি খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়।
ঢাকা পোস্ট : শিক্ষাগত যোগ্যতা বা কোন বয়স থেকে আগ্রহীরা চেষ্টা করবে? এই ধরণের কোনো প্র্যাকটিস আছে?
ফারাবী হাফিজ : বর্তমানে সব চ্যানেলই স্নাতক পাস ছাড়া কাউকে নিয়োগ দিতে চায় না। তবে কলেজের চৌকাঠ পেরিয়ে চেষ্টা করা উচিত। কারণ একজন ছেলে বা মেয়ের সবচেয় আকর্ষণীয় ফেইস হয় এই সময়টাতে। চেহারার মধ্যে এক ধরনের গ্লো থাকে। যা সবাইকে আকর্ষণ করে।
আরও পড়ুন : অনলাইন গণমাধ্যমের আইকন হতে চায় ঢাকা পোস্ট
ঢাকা পোস্ট : প্রার্থীদের যাচাই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে টেলিভিশনের চ্যানেলগুলো কী ধরনের প্রক্রিয়া অবলম্বন করে থাকে।
ফারাবী হাফিজ : টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সাধারণ দুইভাবে প্রার্থীদের বাছাই করে। প্রথমে একটি সাধারণ জ্ঞানের উপর পরীক্ষা নেয়। এই পরীক্ষার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, যিনি সংবাদ উপস্থাপনা করবেন তিনি দেশ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, আইনকানুন ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী সম্পর্কে কতটা জানানে সেটা বুঝার জন্য। এতে উত্তীর্ণ হলে বা একই দিনে অডিশনের আয়োজন করা হয়। এতে প্রার্থীদের খবর পড়তে দেওয়া। তার উচ্চারণ, পড়ার ধরন ও আত্মবিশ্বাস পরখ করে দেখা হয়। যারা এসব পরীক্ষায় ভালো করবেন, তাদের চাকরি হবে। প্রক্রিয়াগুলো খুবই কঠিন, এমন নয়। যারা কিছুটা চটপটে তারাই এসব ক্ষেত্রে ভালো করেন।
ঢাকা পোস্ট : কেউ যদি সংবাদ উপস্থাপনাকে পেশা হিসেবে নিতে চায়, তাহলে তার আয় রোজগার কেমন হবে?
ফারাবী হাফিজ : আয় রোজগারের বিষয়টি চ্যানেল ভেদে ভিন্নতা রয়েছে। যারা খণ্ডকালীন সংবাদ উপস্থাপক হিসেবে কাজ করেন তাদের সম্মানী প্রদান করা হয় প্রতিটি নিউজ অনুসারে। ন্যূনতম ৮শ টাকা থেকে ৫ হাজার টাকা প্রদান করা হয়। পূর্ণকালীন হিসেবে যারা কাজ করেন, তাদের অন্যান্য সবার মতো মাস শেষে বেতন প্রদান করা হয়।
ঢাকা পোস্ট : অনেক তথ্য ও সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
ফারাবী হাফিজ : ঢাকা পোস্টকেও ধন্যবাদ।