প্রতীকী ছবি

বিভিন্ন কারণেই ব্যাংকের চাকরি তরুণদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এরমধ্যে ভালো সুযোগ সুবিধা, দ্রুত পদোন্নতি, সুগঠিত বেতন কাঠামো ও সামাজিক পরিমণ্ডলের ইতিবাচক গ্রহণযোগ্যতা অন্যতম। যেকোনো বিষয়ে পড়াশোনা করে ব্যাংকে চাকরির সুযোগ, স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং দীর্ঘমেয়াদি ক্যারিয়ার গড়ার হাতছানিসহ ব্যাংকারদের সুশৃঙ্খল পরিপাটি জীবন তরুণদের প্রবলভাবে আকৃষ্ট করছে।

শুধু ব্যাংকিং, ফিনান্স, ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি বা ব্যবসাসংক্রান্ত বিষয়ই নয়, বিজ্ঞান, কৃষি প্রকৌশলসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত বিষয়ে ডিগ্রিধারীরাও ঝুঁকে পড়ছেন ব্যাংকের দিকে। এজন্য গত এক দশকে আমাদের দেশের বেকারত্বের হার মোটামুটি ৪ থেকে ৫ শতাংশর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ব্যাংকের চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে গেছে বহু গুণ। অপরদিকে প্রযুক্তির ব্যবহার, ঝুট-ঝামেলা ছাড়া অনলাইনভিত্তিক লেনদেন ব্যাংকিং কার্যক্রমে এনেছে আমূল পরিবর্তন। ফলে অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে ব্যাংকের চাকরি এখন বেশ এগিয়ে। স্মার্ট পেশা হিসেবেও বাড়ছে তুমুল জনপ্রিয়তা।

ব্যাংকগুলো সাধারণত তিন ধাপে নিয়োগ পরীক্ষা নেয়। প্রথমে বহু নির্বাচনী প্রশ্নোত্তর পর্ব এরপর লিখিত পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষায় পাস করলে সুযোগ মিলে মৌখিক পরীক্ষার। চূড়ান্তভাবে নিয়োগ পাওয়া যায় মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক ভেদে পরীক্ষার সময় ও নম্বর বণ্টনে তারতম্য দেখা যায়।

বর্তমানে বাংলাদেশে দেশি-বিদেশি, সরকারি ও বেসরকারি, ইসলামি শরিয়াহভিত্তিক ও বিশেষায়িতসহ মোট ৬৬টি ব্যাংক রয়েছে। ব্যাংকগুলো চাকরি প্রত্যাশীদের চাহিদার কথা বিবেচনা করে বছর জুড়েই বিভিন্ন পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে থাকে। ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির তত্বাবধানে সমন্বিত নিয়োগ ছাড়াও বেসরকারি ব্যাংকগুলোও নিয়মিত লোক নেয়। নিয়োগ পরীক্ষাও হয় যথাযথ নিয়মে। স্বভাবতই নিয়োগ পরীক্ষায় প্রার্থীদের বাড়তি চাপ থাকে। বিশেষত বাংলাদেশ ব্যাংকসহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে চাকরি পেতে আবেদন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ভাইভা পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ধাপ পেরোতে হয়। ফলে প্রস্তুতিটাও থাকা চাই জমপেশ।

কেমন যোগ্যতা থাকা চাই

বাংলাদেশ ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক ও ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির সাবেক সদস্য সচিব মো. মোশাররফ হোসেন খান জানান, ‘আবেদনের জন্য যেকোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা চার বছর মেয়াদি স্নাতক বা স্নাতক (সম্মান) থাকতে হবে। মাধ্যমিক ও তদূর্ধ্ব পর্যায়ে থাকতে হবে কমপক্ষে দুটি প্রথম বিভাগ বা শ্রেণি। কোনো পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগ বা শ্রেণি থাকা যাবে না। এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ে গ্রেডিং পদ্ধতিতে প্রকাশিত ফলের ক্ষেত্রে জিপিএ ৩.০০ বা তার বেশি হলে প্রথম বিভাগ, জিপিএ ২.০০ থেকে ৩.০০ এর কম হলে দ্বিতীয় বিভাগ ধরা হবে।'

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ৪ পয়েন্ট স্কেলে সিজিপিএ ৩.০০ বা বেশি হলে প্রথম বিভাগ বা শ্রেণি, ২.২৫ বা তার বেশি কিন্তু ৩.০০ এর কম দ্বিতীয় বিভাগ হিসেবে ধরা হবে। পয়েন্ট স্কেল ৫ হলে ৩.৭৫  বা এর ওপরে প্রথম বিভাগ বা শ্রেণি, ২.৮১৩ থেকে বেশি কিন্তু ৩.৭৫ এর কম দ্বিতীয় বিভাগ বা শ্রেণি ধরা হবে। বয়স সীমা অনূর্ধ্ব ৩০ বছর। তবে মুক্তিযোদ্ধা/মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে বয়স সীমা ৩২ বছর।’

প্রস্তুতি শুরু হোক এখনই

আবেদনের পরই প্রস্তুতি শুরু করব ভেবে বসে থাকলে আশায় গুড়ে বালি হতে পারে। কারণ বর্তমানে ব্যাংক চাকরি পেতে দরকার হয় দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি ও কৌশলী পড়াশোনা। নিয়মমাফিক ও বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা করতে পারলে অল্প সময়ে ভালো প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব। তাই যাদের লক্ষ ব্যাংকার হওয়া, তাদের উচিত স্নাতক পর্যায় থেকেই প্রস্ততি শুরু করা। আর যাদের স্নাতক শেষ, তারা সময়ের দিকে না তাকিয়ে যেখানে আছেন, সেখান থেকেই শুরু করুন। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, শুরু কিভাবে করব?

‘বহু নির্বাচনী পরীক্ষার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো ভুল উত্তরের জন্য নম্বর কাটার ব্যবস্থা। ফলে যে বিষয়ে দখল ভালো, পরীক্ষায় সেখান থেকেই উত্তর করা শুরু করুন। বাংলা-ইংরেজি উভয় অংশ থেকেই ২০টি করে প্রশ্ন থাকে। বাংলার সাহিত্য অংশ থেকে অধিকাংশ প্রশ্ন এলেও ইংরেজিতে সমার্থক শব্দ, বিপরীত শব্দসহ ব্যাকরণ অংশের প্রাধান্য থাকে। অ্যানালজি, বাক্যে ভুল নির্ণয়, বাক্য সম্পূর্ণকরণ, বাংলায় বানান বা বাক্য শুদ্ধিকরণ, প্রবাদ প্রবচন, বাগধারা, সন্ধি, সমাস, প্রকৃতি ও প্রত্যয়, এক কথায় প্রকাশ থেকে প্রশ্ন আসতে পারে। সহজ প্রশ্নে দ্রুত উত্তর দিয়ে সময় সাশ্রয় করা বুদ্ধিমানের কাজ।

মোঃ জাহিদুল ইসলাম, পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার

উত্তরটা দিয়েছেন আইএফআইসি ব্যাংকের সদ্য নিয়োগ পাওয়া অ্যাসিস্ট্যান্ট অফিসার সানিদ সালেহীন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘শুরু করেছিলাম বিগত বছরের বিভিন্ন ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন সমাধান করে। এসব প্রশ্ন আমাকে নিয়োগ পরীক্ষা সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারনা দিয়েছে। ছাত্রজীবন থেকেই আমার নোট করে পড়ার অভ্যাস। নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতির বেলায় এটি বেশ কাজে দিয়েছে। তাছাড়া আমি বিষয়ভিত্তিক পড়াশোনা করেছি। যেমন বাংলার সময় বাংলাই পড়েছি, ইংরেজির সময় ইংরেজিই পড়েছি। একইসঙ্গে একাধিক বিষয় পড়লে গুলিয়ে ফেলা সম্ভাবনা থাকে। তাই বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে গেছে। একইসঙ্গে নিয়মিত দৈনিক পত্রিকা পড়তাম। এতে সমসাময়িক ঘটনা সম্পর্কে আমি নিয়মিত আপটেড থাকতাম। আমার পরামর্শ, অতো শত না ভেবে এখনই শুরু করে দেওয়া উচিত।’

ব্যাংকগুলো সাধারণত তিন ধাপে নিয়োগ পরীক্ষা নেয়। প্রথমে বহু নির্বাচনী প্রশ্নোত্তর পর্ব এরপর লিখিত পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষায় পাস করলে সুযোগ মিলে মৌখিক পরীক্ষার। চূড়ান্তভাবে নিয়োগ পাওয়া যায় মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক ভেদে পরীক্ষার সময় ও নম্বর বণ্টনে তারতম্য দেখা যায়।

বহু নির্বাচনী পরীক্ষায় দিতে হবে বুদ্ধিমত্তার পরিচয়

কথায় আছে বহু নির্বাচনী পরীক্ষা চাকরি প্রার্থীদের জন্য টিকে থাকার লড়াই, আর নিয়োগকর্তাদের কাছে বাদ দেওয়ার পদ্ধতি। এই অংশে আশানুরূপ ফল পেতে দরকার দীর্ঘমেয়াদি প্রস্তুতি, সচেতনতা ও তাৎক্ষণিক বুদ্ধিমত্তা। এ বিষয় পূবালী ব্যাংকের যশোর শাখার সিনিয়র অফিসার মোঃ. জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বহু নির্বাচনী পরীক্ষার সবচেয়ে বড় অসুবিধা হলো ভুল উত্তরের জন্য নম্বর কাটার ব্যবস্থা। ফলে যে বিষয়ে দখল ভালো, পরীক্ষায় সেখান থেকেই উত্তর করা শুরু করুন। বাংলা-ইংরেজি উভয় অংশ থেকেই ২০টি করে প্রশ্ন থাকে। বাংলার সাহিত্য অংশ থেকে অধিকাংশ প্রশ্ন এলেও ইংরেজিতে সমার্থক শব্দ, বিপরীত শব্দসহ ব্যাকরণ অংশের প্রাধান্য থাকে।

শুধু ব্যাংকিং, ফিনান্স, ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি বা ব্যবসাসংক্রান্ত বিষয়ই নয়, বিজ্ঞান, কৃষি প্রকৌশলসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত বিষয়ে ডিগ্রিধারীরাও ঝুঁকে পড়ছেন ব্যাংকের দিকে। এজন্য গত এক দশকে আমাদের দেশের বেকারত্বের হার মোটামুটি ৪ থেকে ৫ শতাংশর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ব্যাংকের চাকরি প্রার্থীর সংখ্যা বেড়ে গেছে বহু গুণ।

অ্যানালজি, বাক্যে ভুল নির্ণয়, বাক্য সম্পূর্ণকরণ, বাংলায় বানান বা বাক্য শুদ্ধিকরণ, প্রবাদ প্রবচন, বাগধারা, সন্ধি, সমাস, প্রকৃতি ও প্রত্যয়, এক কথায় প্রকাশ থেকে প্রশ্ন আসতে পারে। সহজ প্রশ্নে দ্রুত উত্তর দিয়ে সময় সাশ্রয় করা বুদ্ধিমানের কাজ। আনুপাতিক ভাবে গণিতে বেশি সময় লাগে। গণিত ও অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট মিলে এ অংশ থেকে মোট ৩০টি প্রশ্ন থাকে। সাধারণ গণিতের পাশাপাশি গাণিতিক বিশ্লেষণী ক্ষমতা যাচাইয়ের জন্য অ্যাপ্টিটিউড টেস্ট অংশে গ্রাফ, ছক, টেবিল বা বর্ণনা দেওয়া থাকে, তা থেকে উত্তর দিতে হয়। আগে থেকেই ক্যালকুলেটর ছাড়া অঙ্ক সমাধানের অনুশীলন করলে পরীক্ষার সময় বাড়তি সুবিধা পাওয়া যায়।’ 

লিখিত পরীক্ষার আদ্যোপান্ত

পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের সহকারী মহাপরিচালক শেখ আখতারুজ্জামান জানান,  লিখিত পরীক্ষায় প্রশ্ন করা হবে বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও সাধারণ জ্ঞান থেকে। বাংলায় ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির পাঠ্য বইয়ের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো পড়তে হবে। জানতে হবে কবি-সাহিত্যিকদের জীবন ও কর্ম।

ইংরেজিতে গ্রামার অংশে Tense, Parts of speech, Verb, Translation, Number, Gender, Narration, Voice Change, Correct Form of Verbs, Pronunciation, Synonym, Antonym, Transformation of Sentence, Appropriate Word, Idioms and Phrases থেকে প্রশ্ন আসে। এগুলোর সঙ্গে অনেক vocabulary শিখতে হবে।

গণিতে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির পাঠ্য বই অনুসরণ করতে হবে। সুদকষা, ঐকিক নিয়ম, অনুপাত, সমানুপাত, শতকরা, লসাগু-গ সাগু, লাভ-ক্ষতি, ভগ্নাংশ, লগারিদম থেকে প্রশ্ন আসতে পারে। দেখতে হবে বীজগণিতের সূত্র, অনুসিদ্ধান্ত, জ্যামিতি ও পরিমিতির সাধারণ নিয়মাবলীগুলো।

সাধারণ জ্ঞানের জন্য নজর রাখতে হবে সমসাময়িক বিষয়ের ওপর। জানতে হবে ব্যাংকিং সেক্টরের হালনাগাদ তথ্য। সঙ্গে জানতে হবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আলোচিত বিষয় সম্পর্কে। পড়তে হবে ভালোমানের সাধারণ জ্ঞানের বই, দৈনিক পত্রিকা ও কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স বিষয়ক মাসিক সাময়িকী। এ ছাড়া দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি), রপ্তানি ধারা, প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স, রিজার্ভ, কৃষি পরিস্থিতি, দারিদ্র্য হ্রাস, শ্রমবাজার, বিনিয়োগ পরিস্থিতি প্রভৃতি অগ্রগতির তথ্য টুকে রাখুন, লিখিত অংশে কাজে লাগবে।

ভাইভা পরীক্ষায় ভয়কে জয় করতে হবে

পরিশীলিত, পরিপাটি, অকপটভাবে ভাইভা বোর্ডে নিজেকে উপস্থাপন করতে হলে বিষয়ভিত্তিক ধারণাটা স্পষ্ট থাকা চাই। তাহলে আত্মবিশ্বাসটাও ফুটে উঠবে। নিজের পরিচয়, শিক্ষা, বাড়তি পারদর্শিতা, আগ্রহ-এগুলো সহজভাবে নিজের মতো করে তুলে ধরতে পারলেই অর্ধেক কাজ হয়ে গেল।

পূবালী ব্যাংকের যশোর শাখার সিনিয়র  অফিসার মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, ‘ভাইভার নির্দিষ্ট গণ্ডি নেই। স্নাতক বা স্নাতকোত্তরের বিষয়ের ওপর প্রশ্ন হয়। এ ছাড়া ব্যাংক রিলেটেড প্রশ্নও করা হয়ে থাকে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন করা হয় আপনি কেন ব্যাংকে চাকরি করতে এসেছেন? আপনাকে নিয়োগ দিলে ব্যাংকের কী লাভ হবে? এত প্রার্থী থাকতে আপনি কেন? আপনার মধ্যে কী কী গুণ আছে? আপনার দুর্বল দিক কী? আপনার জেলার দর্শনীয় স্থান, বিখ্যাত খাবার কী? জানতে চাইতে পারে খ্যাতিমান মানুষের নাম, এলাকার মুক্তিযুদ্ধের তথ্য। নিয়মিত পত্রপত্রিকা পড়তে হবে। নিজেকে আপডেট রাখতে হবে। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সহজ ও সাবলীল ভাষায় দিতে হবে। বাংলায় প্রশ্ন করলে বাংলায় এবং ইংরেজিতে প্রশ্ন করলে ইংরেজিতে উত্তর দিতে হবে।’ তাহলে আর দেরী কেন? শুরু হয়ে যাক স্মার্ট পেশার স্মার্ট প্রস্তুতি।