বোরকা ও হিজাব পরে কলেজে যাওয়ার কারণে কট্টর হিজাববিরোধীদের রোষানলে পড়েছিলেন ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় রাজ্য কর্ণাটকের মুসলিম ছাত্রী মুসকান খান। কলেজ ক্যাম্পাসের ভেতরেই বিরোধীদের স্লোগানের মুখে পাল্টা ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়ে ব্যাপক আলোচনায় আসেন তিনি।

তবে হিজাব ইস্যুতে ব্যাপক তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই বুধবার কর্ণাটকের হাইকোর্টে এ বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সাহসী এই মুসলিম শিক্ষার্থী মুসকানও জানিয়েছেন, তিনি রায়ের অপেক্ষায় আছেন এবং হিজাবের বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নেবেন। বুধবার (৯ ফেব্রুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে হায়দ্রাবাদভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সিয়াসাত।

মুসকান খান কর্ণাটক রাজ্যের পিইএস কলেজ অব আর্টস, সাইন্স অ্যান্ড কমার্স’র বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থী। কলেজটি রাজ্যের মান্দিয়া জেলায় অবস্থিত এবং বোরকা পরে যাওয়ার কারণেই মঙ্গলবার কলেজ চত্বরে হিজাববিরোধীদের রোষানলে পড়েন। অত্যন্ত সাহসীকতার সঙ্গে শত শত হিজাববিরোধীর ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগানের পাল্টা ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দেন তিনি।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিভিন্ন প্লাটফর্মে এই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, ওই তরুণী স্কুটার পার্কিংয়ে রেখে কলেজ ভবনের দিকে হাঁটছেন। এ সময় গেরুয়া ওড়না পরা একদল তরুণ ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দেয় এবং তার দিকে এগিয়ে যায়। পাল্টা ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দেওয়ার সময় এই তরুণীকে ভীত দেখা যায়নি। ওই সময় হাত উপরে তুলে আল্লাহু আকবার স্লোগান দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে দেখা যায় তাকে। পরে কলেজের অধ্যক্ষ এবং অন্যান্য শিক্ষকরা তাকে সরিয়ে নেন।

শত শত তরুণের সামনে একাই প্রতিবাদ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রশংসায় ভাসছেন মুসকান খান নামের ওই শিক্ষার্থী। এছাড়া নিজের অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোয় মুসকানকে ৫ লাখ রুপি পুরস্কার দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে জামিয়াত উলামায়ে হিন্দ।

কর্ণাটকের ওই প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের দ্বিতীয়বর্ষে অধ্যয়নরত এই শিক্ষার্থী বুধবার সাংবাদিকদের জানান, ডিপার্টমেন্টে একটি অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার জন্য মঙ্গলবার তিনি কলেজে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘বোরকা পরে কলেজে যাওয়ার কারণে একদল শিক্ষার্থী আমাকে গেইটে আটকানোর চেষ্টা করে। তারা বলেছিল- কলেজে ঢুকতে হলে বোরকা খুলতে হবে না হয় ফিরে যেতে হবে। আমি সেটির প্রতিবাদ করেছি।’

মুসকান আরও বলেন, ‘কট্টরপন্থি ওই হিজাববিরোধীরা একই কাজ আমার অন্য সহপাঠীদের সাথেও করেছে। আমি ওই গ্রুপকে পাল্টা প্রশ্ন করি, কলেজে না প্রবেশ করে আমি কেন বাড়ি ফিরে যাবো? এরপর তাদের কয়েকজন আমার কাছে আসে এবং কানের কাছে জোরে ‘জয় শ্রী রাম’ বলে চিৎকার করে।’

‘আমি সামনে এগোতে থাকলে তারা আমার পিছু পিছু আসতে থাকে এবং আমাকে অবশ্যই বোরকা খুলতে হবে বলে চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু আমি আমার অবস্থানেই ছিলাম।’

মুসকান বলেন, ‘আমি কোনো ভয় পাইনি। আমি কোনো ভয় ছাড়াই ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগান দিয়েছি। তাদের ‘জয় শ্রী রাম’ এবং আমার দেওয়া ‘আল্লাহু আকবার’ স্লোগানের মধ্যে ভুল কিছুই নেই। আমি এখন আদালতের রায়ের জন্য অপেক্ষা করছি। আদালত যে আদেশ দেবে, আমি মেনে নেবো।’

তিনি বলেন, হিজাববিরোধীদের হাত থেকে তাকে রক্ষায় কলেজ কর্তৃপক্ষ সহায়তা করেছে। মুসকানের ভাষায়, ‘যার যার ধর্মীয় রীতি পালন ও অনুসরণ করার অধিকার সব ধর্মেই আছে। আমি আমার ধর্মীয় রীতি পালন করবো।’

এদিকে কর্ণাটকে মুসলিম ছাত্রীদের হিজাব পরার বিষয়ে বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের নর্থ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভের আয়োজন করে দ্য মুসলিম স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি ছাত্র সংগঠন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের সামনে আয়োজিত ওই বিক্ষোভে বহু শিক্ষার্থী অংশ নেন। এর মধ্যে অনেক মেয়ে শিক্ষার্থীও ছিলেন এবং হিজাব পরেই তারা সেখানে বিক্ষোভ করেন।

এসময় কর্ণাটকের আন্দোলনকারীদের সমর্থনে তারা বিভিন্ন ব্যানার বহন করেন। ব্যানারে লেখা ছিল - ‘আমরা, মোহাম্মদ (সাঃ) এর অনুসারী। আমরা ঘৃণার বিরুদ্ধে লড়াই করবো’ এবং ‘কর্ণাটকের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করছি।’

গত এক মাসের বেশি সময় ধরে কর্ণাটকের বিভিন্ন স্কুল কলেজে একদিকে হিজাব পরে ক্লাস করার অনুমতির দাবিতে আন্দোলন করছে মুসলিম ছাত্রীরা। অন্যদিকে হিন্দু শিক্ষার্থীরা গেরুয়া ওড়না পরে হিজাববিরোধী আন্দোলন শুরু করেছে।

কর্ণাটকে এই আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে গত মাসে উদুপি জেলার সরকারি বালিকা পিইউ কলেজে ছয়জন মুসলিম ছাত্রীকে হিজাব পরার কারণে শ্রেণিকক্ষের বাইরে বসতে বাধ্য করার পর। সেই সময় কলেজ প্রশাসন জানায়, ইউনিফর্মের অংশ নয় হিজাব এবং ওই ছাত্রীরা কলেজের নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। ছাত্রীদের  ক্লাসে হিজাব পরার বিষয়ে আপত্তি জানায় স্থানীয় ডানপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠী ও তাদের ছাত্র সংগঠন।

উদুপির এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রাজ্যের মান্দিয়া এবং শিভামোগগা এলাকায়। সেখানকার কলেজ কর্তৃপক্ষ হিজাব নিষিদ্ধ করে। যদিও আইনে হিজাব পরে মুসলিম ছাত্রীদের ক্লাসে আসতে কোনও বাধা নেই।

পরে উদুপির একটি প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্রী হিজাব পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলে আদালতের দ্বারস্থ হন। মঙ্গলবার সেই বিষয়েই কর্ণাটকের হাইকোর্টে শুনানি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বুধবার সেই শুনানি অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে এনডিটিভি।

টিএম