ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের হরিদ্বারে অনুষ্ঠিত ‘ধর্মীয় সম্মেলনে’ নির্দিষ্ট একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে গণহত্যার ডাক দেওয়ায় সৃষ্টি হয়েছিল চাঞ্চল্যের। ক্ষোভ আর ঘৃণা উগরে দেওয়া সেই ধর্মীয় সম্মেলনের একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত হস্তক্ষেপ করে।

আর এরপরই ধর্ম সংসদে সংখ্যালঘুদের গণহত্যার ডাক দেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন বিতর্কিত ধর্মগুরু যতি নরসিংহানন্দ। শনিবার রাতে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর আগে শুক্রবার একই মামলায় গ্রেফতার হয়েছিলেন ওয়াসিম রিজভি ওরফে জিতেন্দ্র নারায়ণ সিং ত্যাগী নামে আরেক অভিযুক্ত।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম বলছে, উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে তথাকথিত ধর্মীয় সম্মেলন নামে পরিচিত ধর্ম সংসদে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যালঘুর জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যার ডাক দেওয়া হয়। বিতর্কিত সেই বক্তব্যের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর ভারতে সৃষ্টি হয় তোলপাড়। শেষ পর্যন্ত সেই ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে হয় দেশটির সর্বোচ্চ আদালতকে।

সর্বোচ্চ আদালতের হস্তক্ষেপের পর শুক্রবার ওয়াসিম রিজভিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওয়াসিম ধর্ম পরিবর্তন করে জিতেন্দ্র নারায়ণ সিং ত্যাগী নাম ধারণ করেন। তার গ্রেফতারের পর মুখ খুলেছিলেন আরেক অভিযুক্ত নরসিংহানন্দ। তিনি পুলিশ কর্মকর্তাদের হুমকি দিয়ে বলেছিলেন, ‘তোমরা সবাই মরবে’। এরপর শনিবার তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, হরিদ্বারে সহিংস ও উগ্র ভাষণ দেওয়ার মামলায় দায়ের হওয়া এফআইআরে ১০ জনেরও বেশি ব্যক্তির নাম রয়েছে। এর মধ্যে নরসিংহানন্দ, জিতেন্দ্র ত্যাগী ও অন্নপূর্ণা উল্লেখযোগ্য।

গত বুধবার ভারতের সুপ্রিম কোর্ট উত্তরাখণ্ড সরকারকে ১০ দিনের মধ্যে তদন্তের বিষয়ে প্রতিবেদনে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেয়। এরপরই নড়েচড়ে বসে উত্তরাখণ্ড পুলিশ। তারই ফলশ্রুতিতে ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে দু’জন শীর্ষ অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হলো।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, গত ১৭ থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের হরিদ্বার শহরে ধর্ম সংসদ নামে একটি ধর্মীয় সম্মেলনের আয়োজন করে কট্টরপন্থি হিন্দু যুব বাহিনীর (ভিএইচপি) এক নেতা। ওই ‘ধর্মীয় সম্মেলনে’ হিন্দু রক্ষা সেনার সভাপতি স্বামী প্রেমানন্দ গিরি, স্বামী আনন্দস্বরূপ, সাধ্বী অন্নপূর্ণা প্রধান বক্তা হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। এছাড়া সম্মেলনের শেষ দিনে বিজেপির নেতা অশ্বিনী উপাধ্যায়ও সেখানে উপস্থিত হন।

টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া সেসময় প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, সম্মেলনের আয়োজক ওই ভিএইচপি নেতা একজন সন্ন্যাসী। ২০১৩ সালে দেশটির মুজাফফরনগর দাঙ্গায় তিনি জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এই দাঙ্গাই পরে ২০১৪ সালে ভারতের জাতীয় নির্বাচনে বিজেপির জয়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে।

ডিসেম্বরেই সোশ্যাল মিডিয়া প্লাটফর্মে এই সম্মেলনের সহিংস ভাষণের অনেক ভিডিও ভাইরাল হয়। আবার সম্মেলনের অনেক ভাষণ সরাসরি সম্প্রচারও করা হয়। ভাইরাল হওয়া সাধু সন্ন্যাসীদের সেই উসকানিমূলক ভাষণে বলা হয়, ভারতে একটি নির্দষ্ট সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর জনসংখ্যা যেভাবে বাড়ছে, এভাবে চলতে থাকলে ২০২৯ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী নির্দিষ্ট ওই সম্প্রদায়ের মানুষ হবেন।

পাশাপাশি হিন্দুদের সতর্ক করে তাদের বলতে শোনা যায়, আগেভাগেই এর প্রস্তুতি নিতে হবে। মোবাইল কেনার আগে হিন্দুদের আগ্নেয়াস্ত্র কিনতে হবে। এমনকি ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানাতে সংখ্যালঘু ওই গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণহত্যারও ডাক দিয়েছিলেন বক্তারা।

পরে হরিদ্বারে আয়োজিত ধর্মীয় সম্মেলনে উগ্র ও সহিংস ভাষণের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করে ভারতের রাজনৈতিক দল তৃণমূল কংগ্রেস। দলটির মুখপাত্র সাকেত গোখলে উত্তরাখণ্ডের জোয়ালাপুর থানায় ওই সভার উদ্যোক্তা ও বক্তাদের বিরুদ্ধে একটি এফআইআর দায়ের করেন। এ ঘটনায় সমালোচনার মুখে পড়ে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপি।

এছাড়া ধর্মীয় সম্মেলনে উগ্র ভাষণের বিরুদ্ধে ভারতের শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন দেশটির অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অঞ্জনা প্রকাশ ও সাংবাদিক কোরবান আলী। এরপর সুপ্রিম কোর্ট উত্তরাখণ্ড সরকারের পাশাপাশি কেন্দ্রীয় সরকার ও দিল্লি পুলিশকে নোটিশ পাঠায়।

উল্লেখ্য, ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫৩-এ, ২৯৫-এ ধারা অনুযায়ী, এই ধরনের সহিংস ও উগ্র বক্তব্য দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

টিএম