মিয়ানমারে কেন অভ্যুত্থান, কী ঘটবে এখন?
• স্বৈরশাসনের পাঁচ দশক পর ২০১১ সালে মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন
• ২০১৫ সালে গণতান্ত্রিকভাবে ১ম জাতীয় নির্বাচনে জয় পায় এনএলডি
• চার বছর পর গত বছরের নভেম্বরেও এনএলডি জয়ী হয়
• নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ করে সেনাবাহিনী
• সোমবার দেশটিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী
বেসামরিক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে রাজি হওয়ার এক দশক পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী দেশটির ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। প্রায় ৫০ বছরের অত্যাচারী সামরিক শাসনের অবসানের পর ২০১১ সালে মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক যাত্রা শুরুর আগে সেনাবাহিনীর এই অভ্যুত্থান দেশজুড়ে আতঙ্ক তৈরি করেছে।
বিজ্ঞাপন
সোমবার ভোরের দিকে অং সান সু চি এবং অন্যান্য রাজনীতিকদের আটকের ঘটনাটি দেশটিতে ১০ বছর আগে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরুর যে আশার সঞ্চার হয়েছিল; সেটি পেছনে ফিরিয়ে নেওয়ার স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
সু চি এবং এক সময়ে তার নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) ২৫ বছরের মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর গত পাঁচ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে। সোমবার সকালের দিকে দেশটির পার্লামেন্টে
সু চির এনএলডির আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বিতীয় মেয়াদে যাত্রা শুরুর কথা ছিল।
কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আড়ালে মিয়ানমার সেনাবাহিনী আসলে দেশটিতে শক্ত নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিল। দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় এবং সংসদের এক চতুর্থাংশ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য সংবিধানে সংরক্ষিত রাখার বিধান থাকায় সেনারচিত এই সংবিধান সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করেছে সেনাবাহিনী।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে— মিয়ানমার সেনাবাহিনী কেন এখন ক্ষমতা ছিনিয়ে নিল। তারচেয়ে বড় প্রশ্ন এখন কী ঘটবে?
নির্বাচনে জালিয়াতিই অভ্যুত্থানের হাতিয়ার?
সেনাবাহিনী ক্ষমতা ছিনিয়ে নেওয়ার কয়েকটি কারণ তুলে ধরেছেন বিবিসির দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া প্রতিনিধি জোনাথন হেড। তিনি বলেন, সোমবার সকালের দিকে দেশটির পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল; যেখানে নির্বাচনী ফল স্বীকৃতি পেতো। কিন্তু এখন আর সেটি হবে না।
গত নভেম্বরের নির্বাচনে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়ে জয়ী হয় এনএলডি; সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যার একগাদা অভিযোগ সত্ত্বেও মিয়ানমারে ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে দলটির। নির্বাচনের পরপরই দেশটির সেনাসমর্থিত বিরোধী দলগুলো ভোট জালিয়াতির অভিযোগ তোলে। বিরোধীদের এই অভিযোগের প্রতিধ্বনি অভ্যুত্থানের পর সেনাসমর্থিত নতুন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ইউ মিন্ট সুয়ে স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে শোনা গেছে।
মিয়ানমারের সাবেক সেনা জেনারেল ও ভাইস প্রেসিডেন্ট ইউ মিন্ট সোয়েকে নতুন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেয়া হয়েছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বলেছেন, গত ৮ নভেম্বরের বহু-দলীয় সাধারণ নির্বাচনে অসংখ্য ভোট জালিয়াতির অভিযোগের সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। যদিও এই অভিযোগের সমর্থনে খুব বেশি প্রমাণ হাজির করতে পারেনি সেনাবাহিনী।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) উপ-পরিচালক ফিল রবার্টসন বলেছেন, মিয়ানমারের নির্বাচনে স্পষ্টতই অং সান সু চি চমৎকার জয় পেয়েছে। সেখানে নির্বাচনী প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। এ ধরনের অভিযোগ নতুন কিছু নয়; যদিও কোনও প্রমাণ ছাড়াই এসব অভিযোগ আনা হয়েছে। মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলকে অমীমাংসিতও বলছেন রবার্টসন।
ভোট মানেই কি ক্ষমতা হারানো? এর উত্তর না।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) উপ-পরিচালক ফিল রবার্টসন
‘জাতির জনকের জন্য লজ্জা’
নভেম্বরের নির্বাচনে সেনাসমর্থিত দেশটির ইউনিয়ন সলিডারিটি পার্টি (ইউএসডিপি) অল্প কিছু আসনে জয় পেয়েছে। নির্বাচনে দলটি ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ করায় তাতে সমর্থন দেয় সেনাবাহিনী। জান্তা শাসনের সময় ২০০৮ সালে রচিত সংবিধানে দেশটির পার্লামেন্টের এক চতুর্থাংশ আসন সামরিক বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়; যে কারণে মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি সেনাবাহিনী ব্যাপক আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়।
শুধুমাত্র পার্লামেন্টের এক চতুর্থাংশ আসনই নিশ্চিত করেনি বরং দেশটির গুরুত্বপূর্ণ স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং সীমান্ত কল্যাণবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণও রেখেছে সেনাবাহিনী। সেনারচিত সংবিধানে কোনও পরিবর্তন না আনায় বেশ কিছু ক্ষেত্রে একক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাও সেনাবাহিনীর রয়েছে। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এনএলডি কি সংবিধানে সংশোধনী আনতে পারতো?
জোনাথন হেড বলেন, সংবিধানে সংশোধনী আনার জন্য পার্লামেন্টের ৭৫ শতাংশ সদস্যের সমর্থনের দরকার হয়। যেখানে ২৫ শতাংশ সদস্য সেনাবাহিনীর হওয়ায় সংবিধানে সংশোধনী আনাটা এনএলডির জন্য প্রায় অসম্ভব কাজ। সাবেক সাংবাদিক ও প্রযুক্তিবিদ আয়ে মিন থ্যান্ট বলেছেন, সেনাবাহিনীর আজকের অভ্যুত্থানের নেপথ্যে আরও কিছু কারণ থাকতে পারে। আর সেটি হলো সরকারের কিছু কর্মকাণ্ড; যা সেনাবাহিনীর জন্য বিব্রতকর এক পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
‘সেনাবাহিনী বহিরাগতদের বিশেষ বিপজ্জনক মনে করে।’
ইয়াঙ্গুন থেকে বিবিসিকে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী নির্বাচনে হারের প্রত্যাশা করেনি। যাদের পরিবারের সদস্যরা সেনাবাহিনীতে আছে তারা অবশ্যই এনএলডির বিরুদ্ধে ভোট দেবেন। কিন্ত এটি তারচেয়েও অনেক বেশি।
আয়ে মিন থ্যান্ট বলেন, দেশের ভেতরে সেনাবাহিনীর অবস্থান কেমন সেটি বোঝা দরকার। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম অং সান সু চিকে ‘মা’ হিসেবে উল্লেখ করে। কিন্তু দেশটির সেনাবাহিনী সু চির বাবাকে ‘জাতির জনক’ হিসেবে মনে করে। এর ফলে দেশ শাসন এবং সু চির বাবার সামরিক মর্যাদার প্রশ্নে সামরিক বাধ্যবাধকতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সেনাবাহিনী। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য মিয়ানমার আরও বেশি উন্মুক্ত হয়েছে; যেটি পছন্দ নয় সেনাবাহিনীর।
আয়ে মিন থ্যান্টের মতে, নভেম্বরের ভোটে রোহিঙ্গারা বঞ্চিত হওয়ায় সৃষ্ট আন্তর্জাতিক উদ্বেগ এবং করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অভ্যুত্থানে প্রেরণা পেয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এসব ঘটনা এখনও আশ্চর্যজনক মনে করছেন তিনি।
কী ঘটবে এখন?
সেনাবাহিনী এখনই কেন ব্যবস্থা নিল সেটি নিয়ে এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। কারণ এই অভ্যুত্থানে সেনাবাহিনীর অর্জন খুব নগন্যই বলা যায়।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের এশিয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পোস্টডক্টোরাল ফেলো জিরার্ড ম্যাককার্থি বলেন, এটি মনে রাখা দরকার যে, মিয়ানমারের বর্তমান পদ্ধতি সেনাবাহিনীর জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক। কমান্ডের ওপর সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের পাশাপাশি বড় আকারের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক বিনিয়োগ আছে এবং যুদ্ধাপরাধে বেসামরিক সরকারের ওপর দায় চাপানোর সুযোগ রয়েছে সেনাবাহিনীর।
এক বছরের জন্য সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলে নেওয়ায় চীন ছাড়া অন্যান্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক অংশীদারদের মিয়ানমার থেকে বিচ্ছিন্ন ও সামরিক বাণিজ্যিক অংশীদারিত্বে ক্ষতি করবে। এছাড়া আরেক মেয়াদে সু চি নেতৃত্বাধীন এনএলডিকে ক্ষমতায় বসানো কোটি কোটি মানুষকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে প্ররোচিত করতে পারে।
তিনি বলেন, সম্ভবত ভবিষ্যতের নির্বাচনে ইউএসডিপির অবস্থানের উন্নতি ঘটানোর আশা করছে। কিন্তু এ ধরনের পদক্ষেপের তাৎপর্যপূর্ণ ঝুঁকিও রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ফিল রবার্টসন সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থান মিয়ানমারকে আরও একবা একটি ‘দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রে’ পরিণত করার ঝুঁকিতে ফেলছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, সেনাবাহিনীর বিপজ্জনক এই পদক্ষেপ দেশের ভেতরে মানুষকে ক্ষুব্দ করে তুলতে পারে।
তিনি বলেন, আমি মনি করি না যে, মিয়ানমারের জনগণ সেনাবাহিনীর এই অভ্যুত্থানকে কোনও ধরনের প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ছেড়ে দেবে। তারা সামরিক ভবিষ্যতের দিকে ফিরে যেতে চান না। তারা সেনাবাহিনীর ক্ষমতায় ফেরার বিরুদ্ধে সু চিকে বাধা হিসেবে দেখছেন।
ফিল রবার্টসন বলছেন, বোঝাপড়ার মাধ্যমে এখনও এই সঙ্কটের সমাধানের আশা রয়েছে। তবে তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, আমরা যদি বড় ধরনের প্রতিবাদের শুরু হতে দেখি, তাহলে আমরা গভীর সঙ্কটে পড়ে যাবো।
এসএস