মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) প্রধান নেতা অং সান সু চিকে আটক করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। একইসঙ্গে দেশটির প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টসহ সু চির দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকেও আটক করা হয়েছে। সোমবার (১ ফেব্রুয়ারি) ভোরে তাদের আটক করা হয়।

ধারণা করা হচ্ছে গতবছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনকে ঘিরে দেশটির ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের প্রধান অং সান সু চি এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্রমবর্ধমান টানাপোড়েনের কারণে দেশটিতে অভ্যুত্থান অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নভেম্বরের ওই নির্বাচনে অং সান সু চির দল এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু নির্বাচনে ব্যাপক জালিয়াতির অভিযোগ তোলে সেনাবাহিনী। আজ সোমবার নব-নির্বাচিত সংসদের প্রথম অধিবেশন বসার কথা ছিল।

কী হয়েছিল দেশটির সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনে? এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও নির্বাচনের সার্বিক ফলাফল এবং সু চির বিরোধী নেতাদের বক্তব্যই বা কি ছিল?

গত বছরের ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে দ্বিতীয়বারের মতো গণতান্ত্রিকভাবে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের মতো দ্বিতীয় নির্বাচনেরও বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)।

মিয়ানমারের নির্বাচন কমিশনের ঘোষণা অনুযায়ী, নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি পার্লামেন্টের ৫০০ আসনের মধ্যে জয়লাভ করে ৩৯৯টি আসনে। আর ২০১৫ সালে প্রথমবারের নির্বাচনে এনএলডি পেয়েছিল ৩৯০টি আসন। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ৩২২টি আসন। তবে এই নির্বাচনে রোহিঙ্গাসহ অনেক ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ভোটাধিকার ছিল না।

গত নির্বাচনে অং সান সু চির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি)। এই দলটিকে দেশটির সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ বলে মনে করা হয়।

নির্বাচনে এনএলডি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও এই ফলাফলকে স্বীকৃতি না দেওয়ার ঘোষণা দেয় মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সমর্থিত বিরোধী দলটি। ভোট সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়নি, তাই নতুন করে আবারও ভোটের আয়োজন করার জন্য সেসময় নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানায় তারা।

অবশ্য ইউএসডিপি’র সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সখ্যতা নতুন নয়। ২০০৮ সালে সেনাবাহিনী নতুন সংবিধান রচনা করার পর দেশটিতে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১০ সালে। ব্যাপক প্রশ্নবিদ্ধ সেই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে ইউএসডিপি। তবে সেই নির্বাচনে অংশ নেয়নি সু চির দল।

গত নির্বাচনের প্রচারণায় এনএলডি’র বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ‘অভিযোগ’ সামনে আনে সেনা সমর্থিত ইউএসডিপি। তাদের অন্যতম একটি অভিযোগ ছিল- ‘এনএলডি বাঙালি মুসলমানদের (মিয়ানমারে) স্বাগত জানিয়েছে।’ মিয়ানমারে সাধারণত রোহিঙ্গাদের বোঝাতে ‘বাঙালি মুসলমান’ এই শব্দ যুগল ব্যবহার করা হয়।

এমনকি নির্বাচন অনুষ্ঠানের আগেই ভোট নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ভোটগ্রহণের মাত্র চার দিন আগে গত ৪ নভেম্বর অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে ইউনিয়ন ইলেকশন কমিশন বা (ইউইসি) সক্ষম কি-না, তা নিয়েই প্রশ্ন তোলে তারা।

অবশ্য নির্বাচনের পর পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা পিপলস অ্যালায়েন্স ফর ক্রেডিবল ইলেকশন (পিএসিই) জানায়, কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন ছিল সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ।

প্রায় পাঁচ দশকের সামরিক স্বৈরশাসনের কবল থেকে ২০১১ সালে বেরিয়ে আসে মিয়ানমার। এরপর গণতান্ত্রিকভাবে দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় গত নভেম্বরে। ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে জয়ী হলেও সংবিধানের বেশ কয়েকটি অনুচ্ছেদের কারণে অং সান সু চি দেশটির ক্ষমতার কেন্দ্রে আসতে পারেননি। স্বামী বিদেশি নাগরিক হওয়ায় মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী দেশটির প্রধান হতে পারেননি তিনি। বরং স্টেট কাউন্সিলরের পদে বসে দেশ পরিচালনা করেছেন এই এনএলডি নেত্রী।

তবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী আবারও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করায় আরও একবার অনিশ্চয়তার মুখে পড়ল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।

টিএম