শিক্ষায় মহামারির আঘাত
স্কুল খুলছে উগান্ডা, ফিরবে কে?
গত অক্টোবরের শেষে উগান্ডার প্রেসিডেন্ট জুবেরি মুসেভেনি দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা স্কুল আগামী জানুয়ারিতে খুলে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দেন। কিন্তু দেশটির ১৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থী ফ্লোরেন্স নাগাবা স্কুল খুললেও ক্লাসে না ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চে উগান্ডায় শিক্ষাসংক্রান্ত সব সুযোগ-সুবিধা বন্ধ হয়ে যায়। তখন থেকে নাগাবা দু’বার অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। সে তার দাদির সঙ্গে যে বাড়িতে থাকত, সেখান থেকে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিজ্ঞাপন
নাগাবা এখন রাজধানী কাম্পালার প্রাণকেন্দ্রের কাম্বোকায়ার একটি ছোট বাড়িতে দুই ছেলেকে নিয়ে বাস করছে। অঞ্চলটি জনাকীর্ণ; যেখানে অপরিকল্পিতভাবে বসতি গড়ে উঠেছে।
‘সন্তানদের নিয়ে কোথায় যাব’, আলজাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নাগাবা প্রশ্নটি ছুড়ে দেয়। সে এখন প্রতিবেশীর জন্য মটরশুঁটির খোসা ছাড়ানোর কাজ করে; যেখানে তার দৈনিক আয় এক ডলারেরও কম। নাগাবা বলছে, ‘আমার দুই ছেলেকে কে দেখাশোনা করবে? আমি যদি স্কুলে ফিরে যাই, তাহলে তাদের খাওয়ানোর জন্য আমি অর্থ কোথায় পাব?’
উগান্ডায় নাগাবার ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। ৮০ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকা, যা পৃথিবীতে দীর্ঘতম; ‘ভালোর চেয়ে বেশি মন্দই’ করেছে—বলছিলেন উগান্ডার ন্যাশনাল টিচার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ফিলবার্ট বাগুমা। তিনি বলেন, ‘কোভিড ১৯ সংক্রান্ত বিধি মেনে স্কুল চালু রাখলে শিক্ষার্থীদের যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যেতে হতো, তার চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি এখন তারা পার করছে।’
দেশটির ন্যাশনাল প্ল্যানিং অথরিটির হিসাব অনুযায়ী, অকাল গর্ভধারণ, বাল্যবিয়ে এবং শিশুশ্রমে জড়ানোর কারণে আগামী জানুয়ারিতে হয়তো ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থী স্কুলে ফিরে যেতে পারবে না।
২০২০ সালের মার্চ থেকে চলতি বছরের জুনের মধ্যে উগান্ডায় ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সী মেয়েদের গর্ভধারণ ২২ দশমিক ৫ শতাংশ বেড়েছে। ইউনিসেফের দেওয়া এক প্রতিবেদনে এমন চিত্র উঠে এসেছে।
অর্থের ছোঁয়া
গত সেপ্টেম্বরে উগান্ডার শিক্ষামন্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি জানেত মুসেভেনি স্কুল বন্ধ রাখার নীতিতে অটল অবস্থানের কথা জানান। তার ভাষ্য ছিল, ‘প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থীকে কোভিড ১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে সুরক্ষিত রাখতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ আফ্রিকার এই দেশটিতে এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে মারা গেছেন তিন হাজার ২৬৯ জন।
গত জুনে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ঢেউয়ের কারণে দেশটিতে ৪২ দিনের লকডাউন জারি করা হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, লকডাউন পরবর্তী সংক্রমণের সংখ্যা চলমান স্কুল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত সমর্থন করে না।
‘নাগাবার মতো আরও যে কিশোরীরা গর্ভধারণ করেছে, কৃষ্টি সম্পর্কিত বিধি এবং সামাজিক নানা কারণে তারা স্কুলে যেতে লজ্জা বোধ করবে’— বলছিলেন সালিমা নামুসোবায়া। তিনি আইএসইআর নামে একটি সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। সংগঠনটি মৌলিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে।
করোনাভাইরাস মহামারির কারণে যে বাবা-মায়েরা অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন, তারা হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—এখন থেকে শুধু ছেলে সন্তানের জন্য খরচ করবেন; মেয়েকে জোরপূর্বক বিয়েতে বাধ্য করবেন।
উগান্ডায় স্কুল বন্ধ থাকার প্রভাব যে শুধু মেয়েদের ওপর পড়েছে, তা বলা যাবে না। ছেলেরাও এ প্রভাবের শিকার। তাদের অনেকে শ্রমবাজারে চলে এসেছে। কেউ খনিতে, কেউ হকার পেশায় আবার কেউ আখ মাড়াই কাজে নাম লিখিয়েছে। অন্যরা যখন ক্লাসে ফেরার কথা ভাবছে, তখন তারা আয়ের উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছে, তা সে যতই কম হোক।
সালিমা নামুসোবায়া বলেন, ‘তারা অর্থের ছোঁয়া পেয়ে গেছে, তাই স্কুলে ফেরার কোনো কারণ দেখছে না।’ কমবয়সী অর্থ উপার্জনকারীরাই যে শুধু এমন ভাবছে, তা নয়।
নাকিতায়ো টেওপিস্টার, যিনি সেন্ট কিজিতো প্রাইমারি স্কুলে প্রায় ১০০ শিক্ষার্থীকে ইংরেজি ও সমাজ বিজ্ঞান পড়াতেন, তিনি এখন কাম্পালার উপশহর মুলাগোতে কাসাভা সবজি ভাজা ও প্যানকেক তৈরির কাজ করেন।
স্বামী চার সন্তান নিয়ে ছেড়ে যাওয়ার পর নাকিতায়ো ভাবেন, যেহেতু ১৬ মাসের বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ রয়েছে, সেহেতু তিনি একটি দোকানের বারান্দা ভাড়া নিয়ে রান্নার কাজ শুরু করবেন। যেই চিন্তা সেই কাজ। শুরু করে দেন খাবার তৈরি। খাবারের দোকানে আসা ক্রেতারা তাকে ভালোবেসে ‘শিক্ষক নাকিতায়ো’ বলে ডাকেন।
শিক্ষক হিসেবে নাকিতায়ো যতটা আয় করতেন, এর চেয়ে বেশি তিনি খাবারের দোকান থেকে আয় করছেন। তিনি বলেন, ‘আমার পরিকল্পনা ব্যবসা বড় করা। আমি আর শিক্ষকতা পেশায় ফিরছি না।’
দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা দিচ্ছে উগান্ডার শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু দেশটিতে থাকা বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকরা কোনো সরকারি সহযোগিতা পাচ্ছেন না। ফলে অনেকে এরইমধ্যে শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে চলে গেছেন। উগান্ডায় ইউনিসেফের শিক্ষা ও কিশোর বিকাশ কর্মসূচির প্রধান নাবেন্দ্র দাহাল বলেন, ‘সব শিক্ষক স্কুলে ফিরবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই।’
করোনায় ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় বেসরকারি অনেক স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। স্কুল প্রাঙ্গণ হয়তো অন্য কোনো কাজের জন্য ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। দেশটির ন্যাশনাল প্ল্যানিং অথরিটির গত আগস্টের পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় সাড়ে তিন হাজার প্রাথমিক ও ৮৩২টি মাধ্যমিক স্কুল অর্থনৈতিক অচলাবস্থায় বন্ধ হয়ে গেছে।
অসম ক্ষতি, বিষম পুনরুদ্ধার
দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থী-শিক্ষকদের ওপর যে প্রভাব পড়েছে, তা প্রশমনে দেশটির সরকারের সক্ষমতা রয়েছে কি-না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয় এরইমধ্যে স্কুল খুলে দেওয়ার কৌশল ঘোষণা করেছে। স্কুলে আক্রান্তদের শনাক্তে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও নজরদারি ব্যবস্থা জোরদার করাসহ স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি কৌশলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্কুলে ফেরাতে উগান্ডার সরকার স্থানীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়কে যুক্ত করতে চাচ্ছে। সরকার স্কুলের অবকাঠামো উন্নয়নে অর্থায়নের পরিকল্পনা করছে, পাশাপাশি প্রায় দুই বছর বিরতি থেকে ফেরা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কথাও ভাবছে।
নাবেন্দ্র দাহাল বলেন, ‘তাদের একটি কৌশল রয়েছে, কিন্তু অর্থ নেই। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলারের ফারাক।’
শিক্ষার্থীরা যাতে বাড়িতে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে, সে লক্ষ্যে গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশটির সরকার রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে বিকল্প পাঠ উপাদান সরবরাহ করছে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এ সুযোগ পাচ্ছে না। আবার অনেকে পেলেও অজ্ঞতার কারণে তাদের বাবা-মায়েরা স্কুল ওয়ার্কে (স্কুলের কাজ) সাহায্য করতে পারছে না। ন্যাশনাল প্ল্যানিং অথরিটি বলছে, অর্ধেক সংখ্যক শিক্ষার্থীই স্কুল বন্ধ থাকার কারণে পড়াশোনা বন্ধ রেখেছে।
‘সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা যে গত বছরের তুলনায় শিখনস্তর থেকে পিছিয়ে পড়ছে, সেটি ধনী ও দরিদ্রদের মধ্যে প্রশস্ত হতে থাকা ব্যবধানকেই নির্দেশ করে’—বলছিলেন আইএসইআরের সালিমা নামুসোবায়া।
তিনি মনে করেন, ‘শিক্ষা এমন একটি বিষয়, যা ব্যবধান কমাতে চেষ্টা করে। তবে এখানে এটি আরও বাজে পরিস্থিতির দিকে যাচ্ছে।’
উগান্ডার ন্যাশনাল টিচার্স ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি ফিলবার্ট বাগুমা সতর্ক করে বলেন, ‘শিক্ষায় এ ব্যাঘাতের জন্য ভবিষ্যতে উচ্চ অর্থনৈতিক মূল্য চুকাতে হতে পারে; তরুণরা উন্নয়ন এবং দেশ দক্ষ মধ্যবিত্ত শ্রেণী তৈরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হতে পারে।’
তবে এত নিরাশার মধ্যে নাবেন্দ্র দাহাল আশার বাণী শুনিয়েছেন। পুনরায় স্কুল খুলে দেওয়ার ক্ষেত্রে নেওয়া কৌশল বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, জনগণ ও নাগরিক সমাজ সরকারের অংশীদার হয়েছে। দাহাল বলেন, ‘কোনো আশা যে নেই, তা নয়। আমরা আত্মবিশ্বাসী যে, কিছুটা উন্নতি করতে পারব।’
আরএইচ