তালেবান এলো, চাকরি গেল, শিক্ষক হলেন মুচি
তালেবান আফগানিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করার পর স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি হারিয়েছেন হাদিয়া আহমাদি নামে এক নারী শিক্ষকা। তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে আয়-রোজগার বন্ধ। বাধ্য হয়ে তীব্র ঠাণ্ডার মধ্যে রাজধানী কাবুলের রাস্তার পাশে বসে মুচির কাজ করছেন তিনি। লক্ষ্য একটাই, কিছুটা অর্থ আয় করে পরিবার নিয়ে দিন কাটানো।
শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স। তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর গত আগস্টের মাঝামাঝিতেই চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন ৪৩ বছর বয়সী এই শিক্ষিকা। এ ঘটনায় নারী অধিকার রক্ষার বিষয়ে তালেবানের প্রতিশ্রুতি আরও একবার প্রশ্নের মুখে পড়লো।
বিজ্ঞাপন
২০ বছর পর গত ১৫ আগস্ট আফগানিস্তান দখলে নেয় তালেবান। এরপর সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে তালেবান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার ঘোষণা দেয়। অবশ্য সরকার গঠন করলেও বিশ্বের কোনো দেশই এখনও পর্যন্ত তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি।
ক্ষমতা দখলের পর থেকেই আশঙ্কা বাড়ছে যে, তালেবান কার্যত কট্টরপন্থার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে এবং নারীদের ওপর কঠোর নিয়মকানুন আরোপ করছে। দেওয়া হচ্ছে নানা বিধিনিষেধও। এমনকি তালেবানের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার কোনো নারীকে স্থান দেওয়া হয়নি।
৪৩ বছর বয়সী আফগান শিক্ষিকা হাদিয়া আহমাদি পাঁচ সন্তানের মা। চাকরি হারিয়ে কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার পরই অন্যের পায়ের জুতা চকচকে করার কাজে নামেন তিনি। আহমাদি বলছেন, ‘যখন দেখি আমার সন্তানেরা খুবই ক্ষুধার্ত, তখন বাধ্য হয়েই রাস্তার পাশে বসে মুচির কাজ করতে শুরু করি আমি।’ তবে নিজের পরিবারের নাম বা পরিচয় প্রকাশ করেননি তিনি।
বিশ্বের কোনো দেশ তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় আন্তর্জাতিক বিভিন্ন দাতা সংস্থা আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তাসহ অর্থ সাহায্য পাঠানো বন্ধ করে দেয়। ফলে দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকট প্রতিদিনই খারাপের দিকে যাচ্ছে।
এমনিতেও তালেবান ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই আফগান অর্থনীতি ব্যাপকভাবে বিদেশি সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিল। তালেবানের শাসনাধীনে তহবিল ও অর্থ সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দিনে দিনে সংকট শুধুই বেড়েছে। আর ভুক্তভোগী হচ্ছেন কেবলই আফগান নাগরিকরা।
জাতিসংঘ বারবার সতর্ক করেছে যে, বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মানবিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে আফগানিস্তান। দেশটির অর্ধেকেরও বেশি মানুষ তীব্র খাদ্য ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে এবং প্রচণ্ড শীতের মধ্যে লাখ লাখ আফগান অনাহারের মধ্যে থাকতে বাধ্য হচ্ছে।
অবশ্য পশ্চিমা সমর্থিত সরকারের শাসনামলে হাদিয়া আহমাদি ও তার পরিবারের অবস্থা বেশ ভালোই ছিল। নিজের এক দশকের শিক্ষকতার চাকরি, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে তার স্বামীর বাবুর্চির চাকরি এবং একটি সরকারি সংস্থায় এক মেয়ের চাকরির সুবাদে বেশ সচ্ছল ভাবেই দিন কাটাতে পারতেন আহমাদি। কিন্তু মাত্র কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে সেসবই এখন ধূসর অতীতে পরিণত হয়েছে।
তালেবান ক্ষমতায় আসার পরই আফগানিস্তানজুড়ে মেয়েদের স্কুলগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। আর এতে করে পরিবারের উপার্জনকারী তিনজনের মধ্যে প্রথম চাকরি হারান হাদিয়া আহমাদি। এর কয়েকদিন পরই তার স্বামী এবং সর্বশেষ তার মেয়েও চাকরি হারান। এমনকি টিউশন ফি দিতে না পারায় কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা বাদ দিতে বাধ্য হন তার এক ছেলে।
নিজেদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করা তো দূরের কথা, দু’বেলা খেয়ে জীবন বাঁচাতেই সংগ্রাম করছে হাদিয়া আহমাদির পরিবার। তিনি বলছেন, ‘আমরা এখন ক্ষুধায় আমাদের দিন পার করছি। আমাদের পরিবারে এমন কেউ নেই, যে কি না অর্থনৈতিকভাবে আমাদের সবাইকে সহায়তা করতে পারে।’
হাদিয়া আরও বলেন, ‘পরিবারের সদস্যদের খাদ্য যোগাতে অনেক বিধবা কাজ করতে চান। আবার অনেক নারীই আছেন, যারা নিজেদের স্বামীকে আর্থিকভাবে সহায়তা করতে কাজ করার অনুমতি চায়। আর তাই তালেবানকে অবশ্যই নারীদের বাইরে কাজের অধিকার দিতে হবে। নারীদের চাকরিও দিতে হবে। কারণ এখন কর্মসংস্থানের কোনো সুযোগই নেই।’
টিএম