জলবায়ু তহবিলে বহুজাতিক সংস্থাগুলোর চোখ, উদ্বিগ্ন দরিদ্র বিশ্ব
জলবায়ু সম্মেলনে বেসরকারি কোম্পানির আনাগোনা একেবারে নতুন কিছু নয়। ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনেই প্রথমবারের মত বেশ কয়েকটি কোম্পানি স্পন্সর হিসাবে হাজির হয়েছিল। কিন্তু গ্লাসগোতে বেসরকারি বিভিন্ন কোম্পানির উপস্থিতি এতটাই সরব যে তা নিয়ে বিশেষ করে দরিদ্র-অনুন্নত দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে সন্দেহ-উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
জলবায়ু সম্মেলনের মুখ্য আয়োজক জাতিসংঘ। কিন্তু গ্লাসগোর কপ সম্মেলন এবার স্পন্সর করছে মাইক্রোসফট, ইউনিলিভার, হিটাচি, গ্লাক্সো-স্মিথক্লাইন, জাগুয়ার-ল্যান্ড রোভার এবং আইকিয়ার মতো প্রায় ডজনখানেক করপোরেট জায়ান্ট।
বিজ্ঞাপন
কপ মূল সম্মেলন ভবনের অদূরে ‘গ্রিন জোন’ নামে আলাদা একটি ভেন্যু তৈরি হয়েছে, যেখানে বেশ কিছু কোম্পানি তাদের উদ্ভাবিত নবায়নযোগ্য জ্বালানি নির্ভর যানবাহন, যন্ত্রপাতি প্রদর্শন করছে। এসব কোম্পানির বেশিরভাগই ব্রিটিশ।
বিশ্ব নেতাদের শীর্ষ বৈঠকের সময় তাদের সাথে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে তার উদ্বেগ জানিয়ে ভাষণ দিয়েছেন অ্যামাজনের বিলিয়নিয়ার কর্ণধার জেফ বেজোস। আফ্রিকায় জমির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি।
অথচ মহাকাশে পর্যটন ব্যবসার প্রতিযোগিতায় উঠে-পড়ে লাগা নিয়ে বেজোস পরিবেশবাদীদের তোপের মুখে রয়েছেন। তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও রয়েছে যে, তিনি এমন সব মার্কিন রাজনীতিবিদদের চাঁদা দিয়েছেন যারা জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি স্বীকারই করেন না।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পর্যবেক্ষক হিসেবে জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেওয়া পরিবেশ ও মানবাধিকারকর্মী কেট রবিনসন জলবায়ু আলোচনায় কর্পোরেট খাতের এই সরব গতিবিধিতে খুবই ক্ষুব্ধ। তিনি বলছেন, ‘আমার মনে হচ্ছে জাতিসংঘের একটি আয়োজন করপোরেট খাত দখল করে নিয়েছে। এটা সত্যিই বিস্ময়কর।’
কেট রবিনসন আরও বলেন, ‘এমন সব কোম্পানি স্পন্সর হিসাবে হাজির হয়েছে যারা নিজেরাই তেল-গ্যাস ব্যবসার সাথে জড়িত। জেফ বেজোস বিশ্ব নেতাদের পাশে দাঁড়িয়ে জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচার নিয়ে কথা বলছেন ... সত্যিই তামাশা।’
পৃথিবীর উষ্ণতা কমানোর চেষ্টা এবং এরই মধ্যে ঘটে যাওয়া বিপদ লাঘবের তহবিল আসবে মূলত ধনী এবং শিল্পোন্নত দেশগুলো থেকে। আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা এবং এশিয়ার অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো দাবি তুলেছে যে, ২০৩০ সাল নাগাদ জলবায়ু সংকট নিরসনে বছরে তাদের জন্য ১ হাজার ৩০০ বিলিয়ন (এক লাখ ত্রিশ হাজার কোটি) ডলারের তহবিল করতে হবে।
বছরে ১৩০০ না হয়ে ৩০০ বিলিয়ন হলেও তাতে ব্যবসার বড় সুযোগ দেখছে পশ্চিমা বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। পশ্চিমা সরকারগুলোও যে সেটাই চাইছে তা বুঝতে জ্যোতিষী হতে হয় না। এ নিয়ে অবশ্য তেমন একটা রাখঢাকও করা হচ্ছে না।
জলবায়ু তহবিল সম্পর্কিত মীমাংসা আলোচনাগুলোতে পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারি প্রতিনিধিরা বেসরকারি খাতকে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত করার কথা বলছেন।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট জলবায়ু বিজ্ঞানী ড. আইনুন নিশাত বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসাবে গ্লাসগো সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ২০১৫ সাল থেকে জলবায়ু তহবিলে, জলবায়ু প্রকল্পে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্তি নিয়ে যে কথা শুরু হয়, তা গ্লাসগোতে অনেক বেড়েছে।
তার ভাষায়, ‘আমার মনে হয় যেসব কারণে গ্লাসগো সম্মেলন নিয়ে ভবিষ্যতে কথা হবে তার প্রধান একটি হবে যে এখান থেকেই জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত নীতি-পরিকল্পনায় সাফল্যের সাথে বেসরকারি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।’
জলবায়ু তহবিলে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্তি নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়ছে অনুন্নত এবং দরিদ্র দেশগুলো, বিশেষ করে যারা জলবায়ুর পরিবর্তনের পরিণতিতে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এসব দেশের কাছে নবায়নযোগ্য জ্বালানির চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঝড়-বন্যা প্রতিরোধে বাঁধ তৈরি, আর খরা-বন্যা-ভাঙ্গন-লবণাক্ততায় বাস্তচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসন।
ফলে, এসব দেশ ভয় পাচ্ছে বেসরকারি খাত অতিরিক্ত সম্পৃক্ত হলে জলবায়ু মোকাবেলার কৌশলের অগ্রাধিকার বদলে যাবে। দুর্গত মানুষের পুনর্বাসন বা জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে অভিযোজনে তাদের সক্ষমতা তৈরির চেয়ে গরীব দেশগুলোর কার্বন নিঃসরণ হ্রাসকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনার চেষ্টা হতে পারে।
কেন গরিব দেশগুলো ভয় পাচ্ছে, সংকট কোথায়?
ব্রিটেনের গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের প্রধান অর্থনীতিবিদ পল স্টিল বিবিসিকে বলেন, মিটিগেশন অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণ কমানোর পেছনে অর্থ দেওয়ার ব্যাপারেই পশ্চিমা দেশের আগ্রহ বেশি।
তিনি বলেন, ‘কারণ, তা হলেই পশ্চিমা দেশের বেসরকারি খাত ব্যবসা পাবে। জলবায়ু পরিবর্তন ঠেকাতে বছরে ১৩০ ট্রিলিয়ন ডলার তহবিলের কথা উঠছে। এর সিংহভাগই আসলে খরচ হবে কার্বন নিঃসরণ কমানোর কাজে। কারণ এটি ভবিষ্যতে একটি বড় ব্যবসার সুযোগ তৈরি করবে।’
আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়ার অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি হিসাবে গ্লাসগো সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন উসুতু কামারা। তিনি বলেন, জলোচ্ছ্বাস এবং সাইক্লোনে তার দেশের গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু অবকাঠামো এবং খোদ রাজধানী শহর চরম হুমকিতে পড়লেও এসব রক্ষার কাজে আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে তেমন কোনো টাকা তারা পাচ্ছেন না। বরং ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সে কাজ তাদের করতে হয়েছে।
তিনি বলছেন, ‘যে টাকা দেওয়া হচ্ছে তা মূলত কার্বন নিঃসরণ কমানোর কাজে। কারণ তাতে হয়তো ব্যবসা হয়, মুনাফা হয়। সে কারণেই ধনী দেশগুলো এদিকে নজর দিচ্ছে বেশি।’
দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষ থেকে জোর দাবি তোলা হচ্ছে যে কমপক্ষে তহবিলের ৫০ শতাংশ এমন সব প্রকল্পে দিতে হবে, যেগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রতিক্রিয়া থেকে মানুষকে বাঁচাবে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে তাদের সাহায্য করবে।
ড. আইনুন নিশাত মনে করেন, জলবায়ু অর্থায়নে বেসরকারি খাতের সম্পৃক্ততা বাড়লে গরীব দেশগুলোতে বিপন্ন মানুষকে রক্ষার চেয়ে সেসব দেশের কার্বন নিঃসরণ কমানোকেই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা হতে পারে।
‘গ্লাসগোতে অর্থায়ন নিয়ে কিছু অগ্রগতি হতে পারে। কিন্তু উন্নত দেশগুলো বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ চায়। মিটিগেশনে (কার্বন নিঃসরণ কমানো) বেসরকারি খাতের আগ্রহ থাকতে পারে, কিন্তু অ্যাডাপটেশনে (জলবায়ু পরিবর্তনে বিপন্ন মানুষের সাহায্য) তাদের আগ্রহ থাকার কথা নয়।’
ড. নিশাত বলেন, কারণ, বেসরকারি খাত মুনাফা ছাড়া এগুবে না। সেই মুনাফা আসবে কার্বন নিরপেক্ষ প্রযুক্তি বিক্রি করে। বাস্তচ্যুত পরিবারের জন্য স্কুল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র তৈরি করে মুনাফা আসবে না।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
টিএম