করোনারোধী ‘বড়ি’ যুগের সূচনা
যদি সাধারণ একটি ‘বড়ি’ কোভিড-১৯ নিরাময়ে সহায়তা করতে পারে, তাহলে কেমন হবে? মার্কিন ফার্মা জায়ান্ট মের্ক এবং ফাইজার তাদের তৈরি মুখে খাওয়ার করোনা বড়ির আশাব্যাঞ্জক ফল প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, বিষণ্নতা-প্রতিরোধী একটি ওষুধও চমকপ্রদ ফল দেখিয়েছে; যা মহামারির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নতুন এক অধ্যায়ের দ্বার উন্মোচন করতে পারে।
এই চিকিৎসা কেমন?
বিজ্ঞাপন
কোভিড-১৯ এর প্রথম উপসর্গ দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘গুরুতর অসুস্থতা’ এবং ‘হাসপাতালে ভর্তি’ এড়াতে বড়িগুলো সেবন করতে হবে। বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে এ ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারে ব্যস্ত সময় পার করছেন বিজ্ঞানীরা।
কয়েক মাসের গবেষণার পর মের্ক এবং ফাইজার বলেছে, ‘তারা সেই অধরা লক্ষ্যে পৌঁছেছে।’
অক্টোবরের শুরুর দিকে মের্ক জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তাদের তৈরি করোনা বড়ি মলনুপিরাভিরের অনুমোদন চাওয়া হয়েছে। একই পথ অনুসরণ করে শুক্রবার প্যাক্সলোভিডের অনুমোদন চেয়েছে ফাইজার।
মের্ক এবং ফাইজারের অ্যান্টি-ভাইরাল এ দুই বড়িই মানবদেহে প্রবেশকারী করোনাভাইরাসের জেনেটিক কোডে সমস্যা সৃষ্টি করে ভাইরাসটির বংশবৃদ্ধি প্রায় স্থবির করে দেয়।
উভয় কোম্পানিই বলেছে, ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, মুখে খাওয়ার এই ওষুধ হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি ব্যাপকভাবে হ্রাস করে।’
ট্রায়ালে দেখা যায়, যারা মলনুপিরাভির নিয়েছেন তাদের মৃত্যু এবং হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায় এবং যারা প্যাক্সলোভিড নিয়েছেন তাদের ক্ষেত্রে এই হার প্রায় ৯০ শতাংশ। যদিও গবেষণার ভিন্ন ভিন্ন প্রটোকোলের কারণে কার্যকারিতার হারের এই তুলনা এড়ানো উচিত।
অন্যদিকে, বিষণ্নতারোধী ফ্লুভোক্সামিন নামের একটি বড়ি; যা ইতোমধ্যে জনসাধারণের কাছে সহজলভ্য হয়েছে, সেটিও করোনার গুরুতর অসুস্থতা ঠেকাতে আশাব্যাঞ্জক ফলাফল দেখিয়েছে বলে গত অক্টোবরে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য-বিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে জানিয়েছেন ব্রাজিলের একদল গবেষক।
করোনার এই চিকিৎসা কেন গুরুত্বপূর্ণ?
এসব ওষুধের কার্যকারিতা যদি নিশ্চিত হয়, তাহলে কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এটি একটি বড় অগ্রগতি হবে। এই বড়িগুলো করোনার বিরুদ্ধে বিশ্বের থেরাপিউটিক অস্ত্রকে শক্তিশালী করবে।
করোনার এখন পর্যন্ত যেসব চিকিৎসা রয়েছে, তার বেশিরভাগই সিনথেটিক অ্যান্টিবডির। কিন্তু যারা ইতিমধ্যে গুরুতর অসুস্থ অথবা ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে এবং টিকা দেওয়া কঠিন; তাদের লক্ষ্য করেই সাধারণত এসব ওষুধ দেওয়া হয়।
করোনা শনাক্ত হওয়ার পর একজন রোগীকে দ্রুতই ‘বড়ি’ দেওয়া যেতে পারে, যা তিনি সহজেই বাড়িতে বসে নিতে পারবেন। এখন পর্যন্ত কোনও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া না দেখানো মের্ক এবং ফাইজারের বড়ির ডোজ পাঁচদিনের মধ্যে প্রায় ১০টি নিতে হবে।
ব্রিটেনের ভাইরোলোজিস্ট স্টিফেন গ্রিফিন সায়েন্স মিডিয়া সেন্টারকে বলেছেন, ‘‘এসব অ্যান্টিভাইরালের সফলতা সার্স-কোভ-২ সংক্রমণের গুরুতর পরিণতি রোধের সক্ষমতায় ‘নতুন এক যুগের সূচনা’ করবে।’’
সীমাবদ্ধতা কী?
মের্ক এবং ফাইজার কেবলমাত্র বিবৃতিতে তাদের ওষুধের সফলতা দাবি করেছে এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ডেটা উন্মুক্ত না করায় তাদের চিকিৎসা এখন পর্যন্ত যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা কঠিন।
গত সেপ্টেম্বরে ফ্রান্সের সংক্রামক ব্যাধি বিশেষজ্ঞ কেরিন ল্যাকোম্বে সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, গবেষণাগুলো যাচাই-বাছাই না করা পর্যন্ত এ ধরনের ঘোষণা অত্যন্ত ‘সতর্কতার সাথে’ বিবেচনা করা উচিত। একই সঙ্গে তিনি বলেন, এসব চিকিত্সা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর জন্য ‘সম্ভাব্য বিশাল’ বাজারের প্রতিনিধিত্ব করে।
যদিও মের্ক এবং ফাইজারের ঘোষণা ‘শুধুমাত্র প্রতিশ্রুতি নয়’ বলে কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
এ দুই কোম্পানি তাদের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে প্রত্যাশার চেয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী ফল পাওয়ায় ট্রায়াল বন্ধ করে দেয়। উভয় কোম্পানির স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষক কমিটি ওষুধের ব্যাপারে ইতিবাচক ছাড়পত্র দিয়েছে।
বিষণ্নতারোধী বড়ি ফ্লুভোক্সামিনের ডেটা সহজলভ্য হলেও তা নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। বেশ কয়েকজন গবেষক অভিযোগ করে বলেছেন, গবেষকরা শুধুমাত্র হাসপাতালে ভর্তির সময় হ্রাসের মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেননি, বরং জরুরি কক্ষে দীর্ঘসময় ধরে থাকার ব্যাপারেও মূল্যায়ন করেছেন। অভিযোগকারীরা বলছেন, ডেটার এই ব্যাখ্যা বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
কখন? এবং দাম কেমন?
যুক্তরাজ্য ইতোমধ্যে মের্কের মলনুপিরাভিরের অনুমোদন দিয়েছে। করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে যাদের গুরুতর অসুস্থতার সম্ভাবনা রয়েছে; বিশেষ করে বয়স্ক, স্থূল লোকজন অথবা যারা ডায়াবেটিসে ভুগছেন; তাদের জন্য এই ওষুধ ব্যবহারে বৃহস্পতিবার বিশ্বে প্রথম মলনুপিরাভির ব্যবহারের অনুমোদন দেয় যুক্তরাজ্য।
যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষও জরুরিভাবে ওষুধটি পর্যালোচনা করছে। অনুমোদনের সম্ভাব্য তারিখ না জানালেও গত বৃহস্পতিবার এই ওষুধের অনুমোদনের গতি ‘ত্বরান্বিত’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইউরোপীয় মেডিসিন্স এজেন্সি (ইএমএ)।
কিছু দেশ ইতিমধ্যে মলনুপিরাভিরের স্টকের অর্ডার দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মলনুপিরাভিরের ১৭ লাখ কোর্স কিনছে। যুক্তরাষ্ট্র ওষুধটি কেনার যে অর্ডার করেছে, তাতে এর উচ্চমূল্য সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের মলনুপিরাভিরের ১৭ লাখ কোর্স ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারে কেনার তথ্য পাওয়া গেছে। এই হিসেবে পাঁচদিনের এক কোর্সের দাম পড়ছে প্রায় ৭০০ মার্কিন ডলার।
ফাইজার তাদের তৈরি প্যাক্সলোভিডের মূল্য এখনও চূড়ান্ত করেনি। তবে ওষুধটি সাশ্রয়ী হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ফাইজার। একই সঙ্গে দেশগুলোর আয়ের ওপর ভিত্তি করে ওষুধের দাম নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছে মার্কিন এই কোম্পানি।
সূত্র: এএফপি।
এসএস