COP26 সত্যিই কি বিশ্বকে বাঁচাতে পারবে
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কপ-২৬ সম্মেলন কি এবার টার্নিং পয়েন্ট হবে? বিশ্ব নেতাদের ব্যর্থতায় পরিবেশ আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গের নিন্দায় কি কোনো কাজ হবে? কপ-২৬ সম্মেলন কি এই গ্রহকে বাঁচাতে পারবে? এ ধরনের নানা প্রশ্নকে সামনে রেখে যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে রোববার স্থানীয় সময় সন্ধ্যায় শুরু হয়েছে বহুল প্রতীক্ষিত কপ-২৬।
তবে একেবারে সাধারণ একটি কারণে এই সম্মেলন নিয়ে আশাবাদী হওয়ার খুব বেশি কিছু নেই। এর আগের ২৫টি বিশাল সম্মেলন বিশ্বজুড়ে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের লাগাম টানতে ব্যর্থ হয়েছে; যা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়িয়ে তুলছে।
বিজ্ঞাপন
তিন দশকের আলোচনা সত্ত্বেও বিশ্ব এখন প্রাক-শিল্প যুগের চেয়ে কমপক্ষে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি বেশি উষ্ণ এবং দিনদিন তা বাড়ছে। এমনকি যদি প্রত্যেকে কার্বন নিঃসরণ কমাতে তাদের বর্তমান প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকেন, তারপরও আমরা চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ২ দশমিক ৭ ডিগ্রির বিপজ্জনক ধারায় থাকব।
যদিও এবারের সম্মেলনে প্রকৃত অগ্রগতির প্রত্যাশা গতানুগতিকের তুলনায় বেশি। এটিও আংশিক, কারণ এখন ঝুঁকি ঘরে আঘাত হানছে। এ বছর জার্মানিতে বন্যায় ২০০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে, শীতল কানাডায় তাপপ্রবাহ আঘাত হেনেছে এবং এমনকি সাইবেরীয় আর্কটিকও পুড়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের পেছনে মানুষের কর্মকাণ্ডই যে দায়ী এবং এটিকে আরও বেশি সহিংস করে তুলছে, বিজ্ঞানীদের কাছে সে বিষয়ে অকাট্য প্রমাণ রয়েছে। এই প্রমাণগুলো আগের চেয়ে আরও বেশি পরিষ্কার যে, সবচেয়ে ক্ষতিকর তাপমাত্রা এড়ানোর উদ্দেশ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণ অর্ধেকে নামিয়ে আনা। আর এই সময়সীমা কাছাকাছিই চলে আসছে।
এবং আমরা কয়েক বছর আগেও অকল্পনীয় কিছু দেখেছি : এই শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ের দিকে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ ‘নেট জিরো’তে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি রক্ষায় দেশগুলোর নজিরবিহীন উচ্ছ্বাস, তাদের কর্মকাণ্ড এবং কিছু কাজ অন্যদের তুলনায় আরও বেশি প্রশংসনীয় ছিল।
এর অর্থ হলো— তারা এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ গ্রিন হাউস নিঃসরণ করছে, তা বায়ুমণ্ডল থেকে শোষণে ভারসাম্য আনবে। আর এটি করবে বৃক্ষ রোপণ ও অন্যান্য পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে। তাহলে কি গ্লাসগো এমন এক মিলনস্থল হবে, যেখানে বিশ্ব কার্বন-শূন্য ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হবে? সত্যি বলতে, শুধুমাত্র একটি সম্মেলনের মাধ্যমে এ ধরনের অর্জন কখনোই সম্ভব নয়।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারের জন্য কপস শুরু হয়েছিল। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সামগ্রিক সমস্যা সমাধানে একমাত্র বৈশ্বিক এই ফোরামের বার্ষিক সম্মেলনে আলোচনা হয়। বিশ্বের প্রায় ২০০টি দেশের ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করলেও কপসে তাদের সবারই ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে।
এ বিষয়ে কপসের একজন কর্মকর্তা বিবিসির বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ডেভিড শুকম্যানকে একবার বলেছিলেন, ‘২০০টি বিড়াল এক সঙ্গে পালনের চেষ্টা করুন।’ তেল বা কয়লা সমৃদ্ধ অনেক দেশ জলবায়ুর সব এজেন্ডার প্রতি বৈরিতা প্রদর্শন করছে এবং এটিকে ধীর করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে।
অন্য যারা দরিদ্র ও দুর্বল তারা ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা দেখছে। এতে তাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ছে এবং সহায়তা পাওয়ার জন্য তারা মরিয়া। বিবিসির ডেভিড শুকম্যান বলছেন, ২০০৫ সালে কানাডার মন্ট্রিলের শীতের গভীর বরফের মধ্যে থেকে আমি প্রথম কপ সম্মেলনের রিপোর্ট করেছি। সেই সময়ের আলোচনার গতি শীতল আবহাওয়ার সাথে মিলে গিয়েছিল।
আলোচকরা একটি পাঠ্যের অমীমাংসিত ও দুর্ভেদ্য পয়েন্টগুলো চিহ্নিত করে রাতারাতি ‘বর্গাকার বন্ধনী’ টেনে তর্ক করছিলেন। শুকম্যান বলেন, অবশেষে তারা এক সকালে চুক্তিতে পৌঁছান এবং আমি তখন যুক্তরাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী মার্গারেট বেকেটকে অশ্রুসজল দেখেছি; আমি একজন প্রবীণ পর্যবেক্ষককে জিজ্ঞাসা করলাম, কী হয়েছে? তিনি বলেছিলেন, তারা কথা চালিয়ে যেতে রাজি হয়েছেন। যে কারণে আলোচনার প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।
তারপর থেকে বছর ঘুরে ঘুরে সম্মেলন হচ্ছে। কখনো বেশি ফলপ্রসূ তো কখনো কম। বিবিসির বিজ্ঞানবিষয়ক এই সম্পাদক বলছেন, আমি এখন পর্যন্ত ৯টি সম্মেলনে অংশ নিয়েছি। সেগুলোর কিছু কিছুতে বেদনাদায়ক দৃশ্যও দেখেছি। ২০০৬ সালে নাইরোবিতে আমি একজন হতাশাগ্রস্ত জার্মান মন্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করতে শুনেছি, অনেকে কেন এখানে আসতে বিব্রত হন। পরের বছর বালিতে জাতিসংঘের পরিশ্রান্ত এবং ক্ষুব্ধ একজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে কাঁদতে দেখা গেছে। এবং ২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে আনাড়ি আয়োজনের কারণে সম্মেলন থেকে ওয়াকআউটও করেছিলেন কেউ কেউ। ফলে আলোচনা প্রায় ভেঙে পড়তে বসেছিল।
তবে এসব সম্মেলন না হলে ‘এখনকার তুলনায় নির্গমন আরও বেশি বেড়ে যেত’ বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইক জ্যাকবস। তিনি বলেন, ‘স্বতঃস্ফুর্ত এবং সম্মিলিত প্রতিশ্রুতি’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারকে সমস্যার দিকে মনোনিবেশ করতে বাধ্য করছে।
আর এসবই কপের বিরল সফলতার উদাহরণ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে ২০১৫ সালের প্যারিস সম্মেলনকে। কারণ এই সম্মেলনের আগ পর্যন্ত বিশ্বের কোনো দেশই বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক শিল্প যুগের ২ ডিগ্রির নিচে রাখতে রাজি হয়নি। এমনকি তারা সর্বনিম্ন দেড় ডিগ্রিতে নামিয়ে আনতে ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন। এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
কপ-২৬ জলবায়ু সম্মেলনের খুঁটিনাটি
• জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বের অন্যতম এক প্রধান সমস্যা। বৃহত্তর বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধ করতে হলে বিশ্বকে অবশ্যই কার্বন নিঃসরণ হ্রাসে আরও উচ্চাভিলাষী প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।
• গ্লাসগোতে এবারের এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে; যেখানে পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মতো বিশ্বের বৃহত্তম দূষণকারীদের প্রতিশ্রুতির দিকে নজর রাখা দরকার।
• আমাদের সবার জীবন বদলে যাবে। এখানে নেওয়া সব সিদ্ধান্ত আমাদের কাজকে প্রভাবিত করতে পারে, আমরা কীভাবে আমাদের বাড়িঘর উত্তপ্ত করছি, কী খাচ্ছি এবং কীভাবে ভ্রমণ করছি; সবকিছুর ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
চুক্তিতে সবচেয়ে কঠিন ছোট একটি অমীমাংসিত বিষয় রেখে দেওয়া হয়েছে এবং এটি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাসেবামূলক। কোনো দেশই তার নিঃসরণ যত দ্রুত করতে চায়, তারচেয়ে কম সময়ে করতে বাধ্য নয়। কিন্তু অধ্যাপক জ্যাকবসের মতে, একটি বৈশ্বিক কাঠামো তৈরির ফলে গতির সঞ্চার হয়েছে। এবং এটি তাৎপর্যপূর্ণ প্রমাণিত হয়েছে।
বিশ্বের আরও অনেক দেশের সরকার এখন পুনঃনবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য তাদের নিজস্ব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ অথবা পেট্রোল এবং ডিজেলচালিত গাড়ি পর্যায়ক্রমে বন্ধ করছে। এটি ব্যবসায়ীদের একটি বার্তা দিচ্ছে যে, এজেন্ডা গুরুতর। সম্প্রতি বায়ু ও সৌর বিদ্যুতে বিনিয়োগ এতটাই বিস্তৃত হয়েছে যে তাদের খরচ কমে গেছে; যার ফলে কার্বন-শূন্য রূপান্তর আরও বেশি সম্ভবপর হয়ে উঠছে।
যদি গ্লাসগো আলোচনা ভেস্তে না যায়, তাহলে পরিবেশের সবুজ দিক নির্দেশনার সংকেতের দিকে আরও বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। এটি একটি ‘টিপিং-পয়েন্ট’ হতে পারে; যেখানে বড় বড় বিনিয়োগকারীরা জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে তাদের ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার স্থানান্তর করতে শুরু করবেন।
এখন পর্যন্ত গৃহীত সব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, বিজ্ঞানীরা গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ ২০৩০ সালের মধ্যে ৪৫ শতাংশ কমিয়ে আনার পরামর্শ দিলেও আসলে তা ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। দুই সপ্তাহের আলোচনার পরও যদি এই চিত্র অপরিবর্তিত থাকে, তাহলে ব্যর্থতার অভিযোগ ঘনঘন এবং দ্রুত উঠবে।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বন্যা ও খরায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোতে অর্থায়ন। দীর্ঘসময় ধরে আর্থিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় তারা হতাশ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে একটি হলো— জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলার জন্য বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা। এই প্রতিশ্রুতি এখনো অপূর্ণই রয়ে গেছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা অধ্যাপক সলিমুল হক বিশ্ব নেতাদের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলার পুরো প্রক্রিয়ার সফলতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন। তার মতে, ‘বাৎসরিক এই গণজমায়েত অপ্রয়োজনীয়। এটি এমন নয় যে জলবায়ু পরিবর্তন বছরের একবারের একটি সমস্যা। এটি ভবিষ্যতের কিছু সময়ের জন্য নয়, বরং প্রত্যেকদিন প্রত্যেকের জীবনে প্রভাব ফেলছে। এতে সবসময় মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।’
তাহলে আপনি কী প্রত্যাশা করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বিবিসিকে তিনি বলেন, আমার ধারণা, তারা শেষ পর্যন্ত টুপি থেকে একটি খরগোশ টেনে বের করতে সক্ষম হবে। কিন্তু তারা যা ঘোষণা করবে, তার বিস্তারিত যাচাই-বাছাই অবশ্যই সাংবাদিকদের করতে হবে। তারা যা বলে আদৌ কি তা সত্য?
শেষ পর্যন্ত এসব সম্মেলন জলবায়ু কর্মকাণ্ডে মানুষের মনযোগ আকর্ষণ করতে পারলেও রাতারাতি রূপান্তরের দিকে নিয়ে যেতে পারে না। মন্ট্রিলের পর্যবেক্ষকরাও বলেছিলেন, এটি একটি প্রক্রিয়া।
গ্লাসগো ঘোষণা শেষে পরবর্তী কপ-২৭ অনুষ্ঠিত হবে মিসরে এবং তার পরেরটি অর্থাৎ কপ-২৮ সম্ভবত কাতারে।
এসএস