ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের জয় কীভাবে ইসলামের বিজয়?
ক্রিকেটের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করার জন্য, ভারতীয় উপমহাদেশে প্রায়ই বলা হয় যে ক্রিকেট একটা ধর্ম। সেই ক্রিকেটেই ভারত-পাকিস্তান মুখোমুখি হলে এই ধর্মের ভূমিকা প্রায় আফিমের মতো বিষাক্ত হয়ে যায়।
পাকিস্তানের মন্ত্রী শেখ রশিদ ছাড়াও আসাদ উমরের বক্তব্য এবং ভারতে মহম্মদ শামির বিরুদ্ধে অনলাইনে করা মন্তব্যগুলো থেকে আরও একবার তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
বিজ্ঞাপন
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে জয়কে ইসলামের জয় বলেছেন। রোববার জয়ের পরপরই টুইটারে একটি ভিডিও বার্তা পোস্ট করেন রশিদ এবং সেখানেই তাকে এমন কথা বলতে শোনা যায়।
শেখ রশিদ এমন কথাও বলেন যে, ভারতের মুসলমানসহ বিশ্বের সমস্ত মুসলমান পাকিস্তানের সাথে রয়েছে। ইসলামের জন্য শুভকামনা। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
পাকিস্তান একটি ইসলামিক দেশ, কিন্তু ক্রিকেট ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিজয়ের পর দেশটার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার দেশকে সারা বিশ্বের মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরছেন।
ভারত সাংবিধানিকভাবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশ এবং পাকিস্তানের পরে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মুসলিমের বাস সেখানে। অথচ শেখ রশিদ ভিডিও বার্তায় এমনভাবে কথা বলেছেন যেন তিনি নিজেকে ভারতীয় মুসলমানদের মুখপাত্র ঘোষণা করেছেন।
— Sheikh Rashid Ahmed (@ShkhRasheed) October 24, 2021
ক্রিকেট ও ধর্ম
তবে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এ ধরনের মন্তব্য এই প্রথম নয়। ২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের কাছে হেরে যাওয়ার পর পাকিস্তানের তৎকালীন অধিনায়ক শোয়েব মালিক মুসলিম বিশ্বের কাছে ক্ষমা চেয়েছিলেন। তখনও ভারতের টেনিস তারকা সানিয়া মির্জাকে বিয়ে করেননি শোয়েব মালিক। তাদের বিয়ে হয় ২০১০ সালে।
২০০৭ সালের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচে পাকিস্তান পরাজিত হয়েছিল। শোয়েব মালিক তখন পাকিস্তান দলের অধিনায়ক ছিলেন। শোয়েব মালিক এই বিশ্বকাপেও পাকিস্তান দলের একজন সদস্য, তবে অধিনায়ক নন।
ভারতের কাছে হারের পর শোয়েব মালিক বলেন, আমি আমার দেশ পাকিস্তান এবং বিশ্বের মুসলমানদের সমর্থনের জন্য ধন্যবাদ জানাই এবং বিশ্বকাপ জিততে না পারার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। যদিও আমরা খেলায় আমাদের শতভাগ দিয়েছি।
সেই ম্যাচে ভারতের ইরফান পাঠান যে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছিলেন তা শোয়েব মালিক ভুলে গিয়েছিলেন। শোয়েব মালিককে ইরফান পাঠানই আউট করেছিলেন। তখন শোয়েব মালিকের ওই বক্তব্যের তীব্র নিন্দা করেছিলেন ভারতের মুসলিম নেতা ও খেলোয়াররা।
দিল্লির সংখ্যালঘু কমিশনের প্রাক্তন প্রধান কামাল ফারুকি বলেছিলেন, তার এসব কথা বলার সাহস হলো কী করে? পাকিস্তানের ভেতরে কী কোনো অমুসলিম সমর্থক নেই? তার বক্তব্য পাকিস্তানের হিন্দু ও খ্রিস্টানদের জন্য অপমানজনক।
তখন ভারতীয় হকির তারকা আসলাম শের খান বলেছিলেন, বেচারা কল্পনার জগতে ভেসে গিয়েছিলেন। এক তো তিনি ইংরেজি খুব ভালো বলতে পারেন না, তাও আবার হারের পর কথা বলছিলেন।
পাকিস্তানি ক্রিকেট
বলা হয়, ড্রেসিংরুমের হালচাল এবং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের ওপর দারুণ প্রভাব ফেলে। ২০০৬ সালে ড. নাসিম আশরাফকে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়। তারপরে তিনি পাকিস্তানি খেলোয়াড়দের তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত কার্যকলাপ প্রকাশ্যে প্রদর্শন না করতে বলেছিলেন। তবে ডক্টর নাসিমের বক্তব্য পাকিস্তানের খেলোয়াড়দের ওপর কোনো প্রভাব ফেলেনি।
এবার ভারতের সঙ্গে ম্যাচে পানি পানের বিরতির সময়ে মাঠেই নামাজ পড়তে দেখা গেল মোহাম্মদ রিজওয়ানকে। শোয়েব আখতার রিজওয়ানের নামাজ পড়ার একটি ভিডিও ক্লিপ টুইট করে লিখেছেন, আল্লাহ সেই ব্যক্তির মাথা কখনও নত হতে দেন না, যেই ব্যক্তি আল্লাহর সামনে মাথা নত করেন। সুবহান আল্লাহ।
— Shoaib Akhtar (@shoaib100mph) October 24, 2021
ডক্টর নাসিম আশরাফ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছিলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে খেলোয়াড়দের ধর্মীয় বিশ্বাস তাদের অনুপ্রাণিত করে। তবে ক্রিকেট ও ধর্মের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হবে।
‘আমি দলের অধিনায়ক ইনজামাম-উল হকের (তৎকালীন অধিনায়ক) সাথে এই বিষয়ে কথা বলেছি। কারো ব্যক্তিগত বিশ্বাসে আমাদের কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু ইনজামামকে বলেছি যে, ইসলাম অন্যের ওপর নিজের মতামত চাপিয়ে দেওয়ার অনুমতি দেয় না।’
২০০৭ সালে শোয়েব মালিকের বক্তব্যের পর কামাল ফারুকি বলেছিলেন যে, পাকিস্তানি খেলোয়াড়রা এ ধরনের কথাবার্তা প্রায়ই বলে থাকেন। ওয়াসিম আকরামের একটি বক্তব্যের কথা স্মরণ করে ফারুকি বলেন, আমার মনে আছে বাংলাদেশের কাছে হেরে যাওয়ার পর ওয়াসিম আকরাম বলেছিলেন, ভাইদের কাছে হেরেছি। এ ধরনের মন্তব্য খেলার চেতনার পরিপন্থী।
বিশ্বকাপে মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের নেতৃত্বে পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারত তিনটি জয় পায়। আজহারউদ্দিন কখনোই ক্রিকেট আর ধর্মকে মেশাননি। পাকিস্তানের খেলোয়াড় ও নেতাদের এমন বক্তব্যকে ভারতের বিপক্ষে জয়ের জন্য চাপ হিসেবেও দেখা হচ্ছে।
— Reema Omer (@reema_omer) October 24, 2021
খেলার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ধর্মীয় নয়
ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার সাবা করিম বিবিসিকে বলেছেন, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে এ ধরনের বক্তব্য একেবারেই অযথা। ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে ক্রিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা খেলা নিয়ে, এটা ধর্মীয় স্তরে নয়। এ ধরনের বক্তব্যে তাদের উন্মাদনাই প্রকাশ পায়। তাদের ভারতের মুসলমানদের মুখপাত্র হওয়ার প্রয়োজন নেই। ভারতের মুসলমানরা টিম ইন্ডিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং তাদের সুখ ও অসন্তোষ ভারতের দলের জয়-পরাজয় দ্বারাই নির্ধারিত হয়।
সাবা আরও বলেন, পাকিস্তান থেকে এসব কথাবার্তা আসায় ভারতের চরমপন্থিরাও অনুপ্রাণিত হয়। তাদের প্রতিক্রিয়ায়ও একই রকম আসে। মহম্মদ শামির ঘটনাটা আমরা দেখতে পাচ্ছি। তবে সাবা করিম মাঠে নামাজ পড়ার বিপক্ষে নন। তিনি বলেন, ধর্মচর্চায় কারো কোনো ক্ষতি হয় না।
শেখ রশিদ ছাড়াও পাকিস্তানের আরেক মন্ত্রী আসাদ উমরও ভারতের পরাজয়ের পর একটা আপত্তিকর টুইট করেছিলেন। আসাদ উমর তার টুইটে লিখেছেন, প্রথমে আমরা তাদের পরাজিত করি, তারপর যখন তারা মাটিতে পড়ে যায় তখন আমরা তাদের চা দিই। আসাদ ওমর মূলত ভারতের উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে খোঁচা দিয়ে এই মন্তব্য করেন।
শেখ রশিদ ও আসাদ উমরের এসব বক্তব্যের নিন্দা হচ্ছে খোদ পাকিস্তানেই।
পাকিস্তানি সাংবাদিক শিরাজ হাসান শেখ রশিদের ভিডিও ক্লিপটি টুইট করে লিখেছেন, বিজয়ের পর বিশ্বের সমস্ত মুসলমানকে শেখ রশিদের অভিনন্দনের কোনো মানে হয় না। দয়া করে রাজনীতি ও ধর্মকে ক্রিকেট থেকে দূরে রাখুন।
পাকিস্তানের আইন বিষয়ক বিশেষজ্ঞ রীমা উমর একই ভিডিও ক্লিপ টুইট করে লিখেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্য বিপজ্জনক এবং বিভেদ সৃষ্টিকারী। যখন ভারতীয় দলে একজন মুসলিম খেলোয়াড়কে তার ধর্মের কারণে আনুগত্য নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে, তখন কিছু মন্ত্রী জয়ের পর এসব মন্তব্য করছেন।
রীমা উমর পাকিস্তানের জয়ের পর বিরাট কোহলির মোহাম্মদ রিজওয়ান এবং বাবর আজমকে আলিঙ্গনের একটি ছবি টুইট করেছেন। তাতে লিখেছেন, ধন্যবাদ খেলোয়াড়দের খেলার চেতনা ও মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য।
পাকিস্তানি দলে থাকা হিন্দু খেলোয়াড় দানিশ কানেরিয়া বহুবার ধর্মীয় বৈষম্যের অভিযোগ তুলেছেন। অন্তত ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে এমন অভিযোগ দেখা যায়নি। পাকিস্তানি ক্রিকেটার ইউসুফ ইয়োহানা ২০০৫ সালে খ্রিস্টান থেকে মুসলিম হন।
এনএফ