চীনের হাত ধরে নতুন অস্ত্র প্রতিযোগিতার সূচনা?
চীন সম্প্রতি পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের যে পরীক্ষা চালিয়েছে, সেটিকে অনেকে মোড় বদলানো ঘটনা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এই পরীক্ষার খবর যুক্তরাষ্ট্রকে চমকে দিয়েছে। এটি আসলেই কতটা চমকে দেওয়ার মতো ঘটনা, সেটি ব্যাখ্যা করেছেন ব্রিটেনের এক্সিটার ইউনিভার্সিটির স্ট্র্যাটেজি ও সিকিউরিটি ইনস্টিটিউটের জনাথান মার্কাস।
গ্রীষ্মকালে, চীনের সামরিক বাহিনী দু’বার মহাকাশে রকেট উৎক্ষেপণ করে, যে রকেট পৃথিবী পরিক্রমা করার পর তার লক্ষ্যবস্তুর দিকে দ্রুতগতিতে ছুটে যায়। প্রথমবার সেটি লক্ষ্যবস্তুর প্রায় ২৪ মাইল দূর দিয়ে চলে যায়, ফলে নিশানায় আঘাত করতে ব্যর্থ হয়। গোয়েন্দা তথ্য বিষয়ক এক ব্রিফিং থেকে যারা এ তথ্য জানতে পারেন, তাদের সাথে কথা বলে প্রথম এই খবর প্রকাশ করে লন্ডন থেকে প্রকাশিত অর্থনীতি বিষয়ক প্রভাবশালী সংবাদপত্র ফাইনানশিয়াল টাইমস।
বিজ্ঞাপন
যুক্তরাষ্ট্রের কিছু রাজনীতিক এবং ভাষ্যকার চীনের কার্যত এই উন্নতিতে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বেইজিং অবশ্য তড়িঘড়ি এই রিপোর্ট নাকচ করে দিয়ে বেশ জোরের সঙ্গে জানায় তারা আসলে পুনর্ব্যবহারযোগ্য একটি মহাকাশ যান পরীক্ষা করছিল।
ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরেতে মিডলবেরি ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশানাল স্টাডিজে পূর্ব এশিয়ায় অস্ত্র বিস্তার রোধ বিষয়ক গবেষণার পরিচালক জেফ্রি লিউইস চীনের এই অস্বীকৃতিকে তাদের বিষয়টি ‘ঘোলাটে করার প্রয়াস’ হিসাবে দেখছেন। তিনি বলছেন, অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে মার্কিন কর্মকর্তারাও এই পরীক্ষার কথা নিশ্চিত করেছেন।
তিনি আরও মনে করছেন, মহাকাশ কক্ষপথে এধরনের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চীন পরীক্ষা চালিয়েছে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, সেটি ‘কারিগরি সক্ষমতার দিক থেকে এবং কৌশলগত কারণে’ চীনের পক্ষে করা খুবই সম্ভব।
আইসিবিএম আর ফবস কী?
আইসিবিএম বা ইন্টারকন্টিনেন্টাল ব্যালিস্টিক মিসাইল একটি দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে বেরিয়ে ছুটতে পারে, আবার পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে। এই ক্ষেপণাস্ত্র অধিবৃত্তাকার গতিপথ ধরে নিশানার দিকে ছুটে চলে।
ফবস বা ফ্র্যাকশনাল অরবিটাল বোম্বার্ডমেন্ট সিস্টেম পদ্ধতিতে ক্ষেপণাস্ত্র পাঠানো হয় আংশিকভাবে পৃথিবীর কক্ষপথে যাতে অপ্রত্যাশিত কোনো স্থান থেকে তা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।
এদিকে ফাইনানশিয়াল টাইমসের খবর এবং চীনের অস্বীকৃতি দু’টিই সত্য হতে পারে বলে জানিয়েছেন অ্যারন স্টেইন। তিনি ফিলাডেলফিয়ায় ফরেন পলিসি ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক।
তার ভাষায়, ‘পুনর্ব্যবহারযোগ্য একটি মহাকাশযানও একটি হাইপারসনিক গ্লাইডার। গ্লাইডার জাতীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে ফবস ব্যবহার করলে সেটা একটা পুনর্ব্যবহারযোগ্য মহাকাশযানের মতই কাজ করবে। কাজেই দু’টি বক্তব্যের মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা খুবই নগণ্য।’
আসলে সম্প্রতি কয়েকমাস ধরে বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তাও এমন ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন যে চীন এই প্রযুক্তিতে অনেক উন্নতি করেছে। ফবস আসলে নতুন কোনো প্রযুক্তি নয়।
স্নায়ু যুদ্ধের সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এই প্রযুক্তির ধারণা নিয়ে কাজ করেছিল এবং চীন এখন মনে হচ্ছে সেই প্রযুক্তি নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার কাজটি পুনরুদ্ধার করছে। এই পদ্ধতিতে ছোঁড়া অস্ত্র পৃথিবীর কক্ষপথে আংশিকভাবে ঢোকে, ফলে কোন দিক থেকে সেটি লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত করবে সেটা অনুমান করা সম্ভব হয় না।
ধারণা করা হচ্ছে, চীন এখন যেটা করেছে সেটি হল, ফবস প্রযুক্তিকে হাইপারসনিক গ্লাইডারের সাথে সংযুক্ত করে নতুন এক প্রযুক্তি তৈরি করেছে। এই প্রযুক্তিতে ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গা ঘেঁষে চলে, যে কারণে কোনো রাডারে তা ধরা পড়ে না বা ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থায় সেটিকে ধ্বংস করাও সম্ভব হয় না।
চীনের লক্ষ্য কী?
জেফ্রি লিউইস বলছেন, ‘বেইজিংয়ের আশঙ্কা চীনের পরমাণু প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্র তাদের আধুনিক পারমাণবিক অস্ত্র এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা সমন্বিত ভাবে ব্যবহার করবে।’
আর অ্যারন স্টেইন বলছেন, পরমাণু শক্তিধর বড় দেশগুলোর বেশিরভাগই এখন হাইপারসনিক মিসাইল ব্যবস্থা গড়ে তুলছে, তবে এই প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে তফাৎ রয়েছে। তার যুক্তি, দৃষ্টিভঙ্গির এই তফাৎই এক দেশকে আরেক দেশের অভিপ্রায় নিয়ে অতিমাত্রায় সন্দিগ্ধ করে তুলছে এবং অস্ত্র প্রতিযোগিতায় মূল ইন্ধন যোগাচ্ছে।
অ্যারন স্টেইনের বিশ্বাস, চীন এবং রাশিয়া মনে করে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, মিসাইল প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে পরাজিত করার নিশ্চিত একটা প্রযুক্তি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চায়, তাদের বিবেচনায় সেইসব লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করতে, যেগুলো পারমাণবিক অস্ত্রের কমান্ড এবং নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়।
চীনের ‘স্পুটনিক মুহূর্ত’
যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু শক্তির দ্রুত আধুনিকায়নকে যারা সমর্থন করেন, তারা চীনের এই সাম্প্রতিক পরীক্ষাকে দেশটির ‘স্পুটনিক মুহূর্ত’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। ১৯৫০ এর শেষ দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন মহাকাশের কক্ষপথে সফলভাবে তাদের উপগ্রহ পাঠায়, তখন সোভিয়েত সাফল্যে এ ধরনের বিস্ময় ও শঙ্কা প্রকাশ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। তারা মনে করেন না যে চীনের এই সাম্প্রতিক পরীক্ষা নতুন করে কোনো হুমকি সৃষ্টি করেছে। কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশানাল পিস’র জেমস অ্যাকটন বলছেন, অন্তত ১৯৮০-র দশক থেকে আমেরিকা মনে করে তারা চীনের দিক থেকে পারমাণবিক হামলার হুমকিতে রয়েছে।
তবে তিনি মনে করেন, চীন, রাশিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচি আমেরিকার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে পরাস্ত করতে যেভাবে উঠে পড়ে এগোচ্ছে, তাতে আমেরিকা এখন দেখতে চাইবে এধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সীমিত রাখতে বিধিনিষেধ আরোপ করে যেসব চুক্তি রয়েছে, সেগুলো আমেরিকার স্বার্থে কাজ করবে কি না।
লিউইস জোর দিচ্ছেন যে, এখানে আমেরিকাকে ঝুঁকিটা সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। তার ভাষায়, ‘আমার আশঙ্কা বিষয়টা নাইন-ইলেভেনের মতো না হয়ে দাঁড়ায়! ১১ সেপ্টেম্বরের হামলার পর দিশেহারা হয়ে আবার হামলার ঝুঁকি ও আশঙ্কা থেকে আমরা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একের পর এক বিপর্যয়কর সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যা আমাদের নিরাপত্তাকে আরও ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।’
‘বস্তুত আমরা যেসব পদক্ষেপ নিয়েছি তার একটি হল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রবিরোধী চুক্তি এবিএম চুক্তি থেকে আমরা সরে এসেছি। চীনের এই হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে এগোনোর পেছনে অন্য যে কারণই থাক না কেন- সবচেয়ে বড় কারণ হল এটিই।’
যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য সবগুলো বৈরী দেশই তাদের পারমাণবিক অস্ত্র ভাণ্ডার আধুনিক এবং আরও সমৃদ্ধ করছে। চীনের অস্ত্র সম্ভার আমেরিকার তুলনায় নগণ্য। কিন্তু মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা আর দূরপাল্লার লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে আঘাত করার প্রযুক্তি নিয়ে উদ্বেগ থেকেই চীন তাদের পরমাণু অস্ত্রের ভাণ্ডার আরও উন্নত, আরও শক্তিশালী করছে।
উত্তর কোরিয়াও বসে নেই। তারাও তাদের পরমাণু সক্ষমতা বাড়াচ্ছে এবং আধুনিক অস্ত্র তৈরি করছে।
কার্নেগি এনডাওমেন্টের অঙ্কিত পান্ডা বলছেন, সাম্প্রতিক কয়েক বছরে উত্তর কোরিয়া তাদের যুক্তরাষ্ট্রের সমকক্ষ হিসাবে দাবি করে চলেছে এবং তারা মনে করছে রাষ্ট্র হিসাবে মর্যাদা বাড়াতে এবং সম্মান অর্জন করতে অত্যাধুনিক পারমাণবিক অস্ত্র এবং শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করার বিকল্প নেই।
পারমাণবিক অস্ত্রের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার এই প্রতিযোগিতা বাইডেন প্রশাসনের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। শীতল যুদ্ধের সময় থেকে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের যেসব চুক্তি উত্তরাধিকার সূত্রে চলে আসছে, তার অনেকগুলোই আর সময়োপযোগী নয়। মস্কো আর বেইজিংয়ের সাথে সম্পর্কে টানাপোড়েনও অস্বস্তির একটা বড় কারণ।
পান্ডা মনে করেন, অস্ত্র ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার এই দৌড়, অস্ত্র তৈরির এই প্রতিযোগিতা ঠেকাতে আমেরিকার জন্য অর্থবহ একটা পথ হবে ‘ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে যাওয়া।’
তিনি মনে করেন, ‘একমাত্র আলোচনার মধ্যে দিয়ে রাশিয়া আর চীনের সঙ্গে একটা অর্থবহ চুক্তি বা সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব। আলোচনার মধ্যে দিয়ে কোনো ছাড় আদায় করতে পারলে তবেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির ব্যয়বহুল ও বিপজ্জনক এই দৌড়ে রাশ টানা সম্ভব।’
সূত্র: বিবিসি বাংলা
টিএম