যেভাবে মানবশরীরে কাজ করছে শূকরের কিডনি
যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের একদল চিকিৎসক সম্প্রতি মানবদেহে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন। এর মাধ্যমে অনন্য এক সাফল্যের দেখা পেয়েছেন তারা। মানুষের শরীরে প্রাণীর কিডনি প্রতিস্থাপনে সফলতার জন্য কয়েক দশকের প্রচেষ্টায় নিউইয়র্কের চিকিৎসকরা প্রথম সফলতা পেলেন।
চিকিৎসকরা বলেছেন, শূকরের একটি জিন পাল্টে দিয়েছিলেন তারা। পরে পরিবর্তিত জিনে নতুন শূকরের জন্ম দিয়ে সেটি বড় করে তোলেন। এরপর সেই শূকরের কিডনি মানবদেহে প্রতিস্থাপন করে দেখতে পান সেটি স্বাভাবিকভাবেই কাজ করছে।
বিজ্ঞাপন
কারা এ কাজটি করেছেন?
এনওয়াইইউ (নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি) ল্যাঙ্গোন হেলথের চিকিৎসক দল মানবদেহে সফলভাবে শূকরের কিডনি প্রতিস্থাপন করেছেন। তারা একটি শূকরের জিনের বদল ঘটিয়ে তার কিডনি নিয়ে করেছেন এই অসাধ্যসাধন। কিডনির কাজকর্ম, তার সফলতা বোঝার জন্য জন্য ৫৪ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণ চলেছে।
ড. রবার্ট মন্টগোমেরি এই চিকিৎসক দলের নেতৃত্বে রয়েছেন। তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, কিডনি তার কাজ শুরু করে দিয়েছে পুরোদমে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ভালো মাত্রায় ইউরিন সেটি রের করে দিতে পারছে। এর ফলে ব্রেন-ডেড ওই ব্যক্তির রক্তে ক্রিয়েটিনিনের মাত্র কমে পৌঁছেছে ১.৯ থেকে ০.৮-এ।
ড. মন্টগোমেরি যেমন এক দিকে অধ্যাপক, সেই সঙ্গে আবার এনওয়াইইউ ল্যাঙ্গোন হেলথের ডিপার্টমেন্ট অব সার্জারির প্রধান ও এই সংস্থার ট্রান্সপ্লান্ট ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর। যদি দীর্ঘমেয়াদে তিনি এই কাজ করেন, তা হলে জিনোট্রান্সপ্লান্টেশন অথবা দু’টি ভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিষয়টি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। অঙ্গ-সংকটের অবসান হবে। বহু মানুষের জীবন বেঁচে যাবে।
কেন জিন-বদলানো শূকরের অঙ্গ কাজে লাগানো হলো?
প্রতিস্থাপনের দিনটা ছিল সেপ্টেম্বরের ২৫ তারিখ। শূকরের থেকে কিডনি নেওয়া হয়। চিনির কণার জিন আলফা-গ্যাল সাধারণ ভাবে মানবশরীরে থাকে না। এটি মানবশরীরের রোগপ্রতিরোধের ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক। কিডনি থেকে তাই এই জিন বাদ দেওয়া হয়।
এই ভাবে জিন-বদলানো শূকরকে বলা হয় গ্যালসেফ শূকর এবং এই জাতীয় শূকরের মাংস যাদের পর্কে অ্যালার্জি রয়েছে, তারা খেতে পারেন। সেই ছাড়পত্রও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ)। এই শূকর ফার্মাকোলজিতেও ব্যবহার করা হয়। এর অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। পেরিয়েছে বেশ কয়েকটি নিয়মের বেড়াজালও। ড. মন্টগোমেরি বলছেন, শূকর-অঙ্গের সঙ্গে মানব-অঙ্গের আকারের সদৃশ্য রয়েছে। শূকরের জিনের বদল করাও সহজ।
ডাক্তাররা মানব শরীরের ভেতরে কিডনি প্রতিস্থাপিত করেছেন?
না, সেটি তারা করেননি। রক্তনালির সঙ্গে সংযুক্ত করে, পেটের বাইরে রাখা রয়েছে। পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। যাতে কোনো আঁচ না লাগে সেই ব্যবস্থার কোনো ত্রুটি নেই। ড. মস্টগোমেরি বলছেন, ৫৪ ঘণ্টা ধরে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে কিডনিটিকে। সেটি গোলাপি বর্ণেরই আছে, কাজের কাজটি করে চলেছে এই সময়ে।
তিন বলছেন, প্রতি ১২ ঘণ্টায় কিডনিটিকে পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে, মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে সবটা দেখা হচ্ছে এবং এখনও পর্যন্ত খারাপ কোনো ইঙ্গিত মেলেনি। মানবশরীর থেকে কোনো ক্ষতিকর অ্যান্টিবডিও কিডনিতে হামলা করেনি। চিনির কণার জিনটির বদল করার ফলে গতিপ্রকৃতি ঠিক মতো এগোচ্ছে। চিকিৎসক দলটি এফডিএ অনুমোদিত পুরনো কিছু ইমিউনোপ্রেজেন্ট ওষুধ ব্যবহার করেছে, যাতে অন্য কোনো সংক্রমণ না হয় সেজন্য জন্য সব চেষ্টাই হয়েছে।
কেন এর এত গুরুত্ব?
ড. মন্টগোমেরি বলেছেন, ‘কারোর মৃত্যুতে কেউ বাঁচে, যে ভাবে অঙ্গ-বিকলের ঘটনা প্রতিদিনই বাড়ছে, তাতে পুরনো এই স্বতঃসিদ্ধটাই ভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। কারণ, অঙ্গের প্রয়োজনটা অনেক বেশি হয়ে গেছে। এত অঙ্গ কোথায় মিলবে, কারাই বা দেবে, তাই যাদের প্রয়োজন তাদের মাঝে হাহাকার-দশা চলছে। মানব অঙ্গ সরবরাহকে এ ক্ষেত্রে পেট্রোলিয়ামের মতো ফসিল ফুয়েল যদি মনে করেন, তা হলে শূকরের অঙ্গকে বায়ুশক্তি বা সৌর শক্তি ভাবা যেতে পারে।’
তবে, এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি ফলাফলটা বোঝার প্রয়োজন রয়েছে। যদিও চিকিৎসকরা আত্মবিশ্বাসী যে, শূকরের কিডনি জীবিত মানব শরীর প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হবে বছর দু’য়েকের মধ্যেই। আর বছর দশেকের মধ্যে হার্ট, ফুসফুস, যকৃতেও এমন অগ্রগতি হবে বলেই মন্টগোমেরি মনে করছেন।
অবশ্য তিন বছর আগে মন্টগোমারি নিজেও অঙ্গ প্রতিস্থাপন করেছিলেন। হেপাটাইটিস সি আক্রান্ত একজন দাতার কাছ থেকে হৃদযন্ত্র নিয়েছিলেন তিনি। নিউইয়র্কের এই চিকিৎসক বলেন, আমি সেই ব্যক্তিদের একজন ছিলাম; যারা আইসিইউতে শুয়ে অপেক্ষা করছিলেন। আমি জানতাম না, আদৌ কোনও অঙ্গ সময়মতো আসবে কি-না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বেশ কয়েকটি বায়োটেক কোম্পানি মানব দেহের অঙ্গের ঘাটতি মেটাতে সহায়তা করার জন্য প্রতিস্থাপনের উপযুক্ত শূকরের অঙ্গ তৈরির কাজ করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ৯০ হাজারেরও বেশি মানুষ কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণছেন। দেশটিতে গড়ে প্রতিদিন কিডনি প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় থাকা অন্তত ১২ জন মারা যান।
টিএম