অস্ত্র ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে যেভাবে ক্ষমতা ধরে রেখেছে উত্তর কোরিয়া
গোপনীয়তার অভ্যাসটা এত দিনেও ছাড়তে পারেননি কিম কুক-সং। তার একটি ইন্টারভিউ পেতে কয়েক সপ্তাহ ধরে তাকে বোঝানো হয়েছে। তিনি ক্যামেরার সামনে এলেন কালো সানগ্লাস পরে।
কিম উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাধর গুপ্তচর সংস্থায় ৩০ বছর ধরে কাজ করেছেন। তার ভাষায়, এই সংস্থাটি হচ্ছে ‘উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতার চোখ, কান এবং মগজ।’
বিজ্ঞাপন
কিম কুক-সং দাবি করছেন, তিনি উত্তর কোরিয়ার নেতাদের সব গোপন খবর জানেন, তাদের সমালোচকদের হত্যা করতে তিনি হত্যাকারী পাঠাতেন এবং এমনকি ‘বিপ্লবের’ জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে অবৈধ মাদক কারখানাও খুলেছিলেন।
এখন উত্তর কোরিয়ার এই সাবেক কর্নেল বিবিসির কাছে সবকিছু ফাঁস করে দিয়েছেন। প্রথম সারির কোনো সংবাদমাধ্যমের কাছে পিয়ংইয়ংয়ের কোনো শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার এটিই প্রথম সাক্ষাৎকার। সাক্ষাৎকারে কিম বিবিসিকে বলেছেন, উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট সরকারের মধ্যে তিনি ছিলেন ‘লালের চাইতেও লাল’ - অর্থাৎ একজন খুবই অনুগত কমিউনিস্ট।
তিনি বলছেন, উত্তর কোরিয়ায় কোনো ব্যক্তির সামরিক মর্যাদা কিংবা আনুগত্য তার নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারে না। প্রাণ বাঁচানোর জন্য তিনি ২০১৫ সালে পক্ষ ত্যাগ করেন। তখন থেকে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে বসবাস করছেন এবং দেশটির গুপ্তচর সংস্থার সাথে কাজ করছেন।
ওই সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, অর্থ সংগ্রহের জন্য উত্তর কোরিয়ার সরকার কিভাবে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকাতে অস্ত্র ও মাদক বিক্রি করছে। এছাড়া পিয়ংইয়ংয়ের সরকারের মধ্যে কীভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, কীভাবে দক্ষিণ কোরিয়ার ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা করা হয় এবং উত্তর কোরিয়ার গোপন গুপ্তচর বাহিনী ও সাইবার টিম কীভাবে বিশ্বজুড়ে তৎপরতা চালাতে পারে, কিম সেই বর্ণনাও দিয়েছেন। তবে কোনো নিরপেক্ষ সূত্র থেকে বিবিসি এসব দাবি যাচাই করতে পারেনি।
উত্তর কোরিয়ার শীর্ষ গুপ্তচর সংস্থায় কিমের শেষ কয়েকটি বছরে তিনি বর্তমান নেতা কিম জং উনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের গোঁড়ার দিকটি দেখার সুযোগ পেয়েছিলেন। তিনি জানালেন, কিম জং উন ছিলেন একজন তরুণ যিনি নিজেকে একজন ‘যোদ্ধা’ হিসেবে প্রমাণ করতে সচেষ্ট ছিলেন।
উত্তর কোরিয়া ২০০৯ সালে নতুন একটি গুপ্তচর সংস্থা গঠন করে, যার নাম রিকনিস্যান্স জেনারেল ব্যুরো। সে সময়টাতে কিম জং উনের বাবার স্ট্রোক হয়েছিল। কিম জং উনকে গড়ে তোলা হচ্ছিল নতুন নেতা হিসেবে। ওই ব্যুরোর প্রধান ছিলেন কিম ইয়ং-চোল, যিনি এখনও উত্তর কোরিয়ার নেতার খুবই আস্থাভাজন সহচর।
কিম জানালেন, ২০০৯ সালের মে মাসে তাদের কাছে একটি আদেশ এলো একটি সন্ত্রাসী টাস্কফোর্স গড়ে তুলতে। লক্ষ্য ছিল উত্তর কোরিয়ার পক্ষ ত্যাগকারী এক কর্মকর্তাকে হত্যা করা। তার ভাষায়, ‘কিম জং উনের জন্য এটি ছিল সর্বোচ্চ নেতা (তার বাবা)-কে সন্তুষ্ট করার এক প্রয়াস। ওই কর্মকর্তা হুয়াং জাং-ইয়পকে হত্যা করতে একটি ‘সন্ত্রাসী টাস্কফোর্স’ গড়ে তোলা হয়। আমি ব্যক্তিগত ভাবে এতে নেতৃত্ব দিই।’
হুয়াং জাং-ইয়প ছিলেন উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাধর কর্মকর্তাদের একজন। উত্তর কোরিয়ার নীতিনির্ধারণীতে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু ১৯৯৭ সালে পক্ষ ত্যাগ করে দক্ষিণ কোরিয়ায় চলে যাওয়াটাকে উত্তর কোরিয়ার সরকার একেবারেই ক্ষমা করতে পারেনি। সেজন্যই পিয়ংইয়ংয়ের শাসক পরিবার চেয়েছিল প্রতিশোধ নিতে।
কিন্তু সেই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। এই ষড়যন্ত্রের দায়ে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনীর দু’জন মেজর এখন সিউলে ১০ বছর সাজা খাটছেন। এই হত্যা প্রচেষ্টার কথা পিয়ংইয়ং সরকার বরাবরই অস্বীকার করে আসছে এবং বলে আসছে যে এটি দক্ষিণ কোরিয়ার সাজানো নাটক। কিন্তু কিমের এই জবানবন্দী ভিন্ন কথা বলছে।
কিম বলছেন, ‘উত্তর কোরিয়ায় কিম জং ইল এবং কিম জং উনের মর্যাদা রক্ষার জন্য সন্ত্রাস হচ্ছে একটি রাজনৈতিক হাতিয়ার। মহান নেতাকে খুশি করার জন্য এটি ছিল এক উপহার।’
কিন্তু ঘটনা এর পরও ঘটেছে। এক বছর পর ২০১০ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার নৌবাহিনীর চেওনান নামে একটি জাহাজ টর্পেডো দিয়ে আঘাত করে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। এতে ৪৬ জন মারা যায়। ওই হামলায় জড়িত থাকার কথাও উত্তর কোরিয়ার সরকার অস্বীকার করেছে।
একই বছর নভেম্বর মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি দ্বীপ ইয়ংপিয়ংয়ের ওপর উত্তর কোরিয়ার গোলন্দাজ বাহিনী কয়েক ডজন গোলা বর্ষণ করে। এতে দুজন সৈন্য এবং দু'জন বেসামরিক লোক নিহত হয়। ওই হামলাটি কার নির্দেশে ঘটানো হয়েছে তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
কিম বলছেন, তিনি ‘চেওনান এবং ইয়ংপিয়ংয়ের ওপর হামলার সাথে তিনি জড়িত ছিলেন না। কিন্তু এসব হামলার কথা আরজিবি অফিসারদের কাছে গোপন ছিল না এবং তারা গর্বের সাথে এসব কথা বলাবলি করতো।’
আর এসব অপারেশন শীর্ষ নেতার নির্দেশ ছাড়া ঘটা সম্ভব ছিল না বলে তিনি বলছেন। তিনি বলছেন, ‘উত্তর কোরিয়ায় এমনকি যখন একটি রাস্তা নির্মাণ হয়, সেটা সর্বোচ্চ নেতার সরাসরি অনুমোদন ছাড়া হয় না। চেওনান জাহাজটি ডুবিয়ে দেওয়া কিংবা ইয়ংপিয়ং দ্বীপের ওপর হামলা কোনো নিম্নপদস্থ কর্মকর্তার কাজ হতে পারে না। এ ধরনের সামরিক কাজের পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়ন কিম জং উনের বিশেষ নির্দেশেই ঘটে। এটা একটি সাফল্য।’
উত্তর কোরিয়া দরিদ্র দেশ হলেও পক্ষ ত্যাগকারী ব্যক্তিরা অনেক আগেই জানিয়েছেন যে, পিয়ংইয়ং সরকারের অধীনে অন্তত ৬ হাজার দক্ষ হ্যাকার রয়েছে। কিমের দাবি অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং ইল সেই ১৯৮০-র দশক থেকেই ‘সাইবার যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে’ নতুন কর্মী প্রশিক্ষণের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
সাবেক উত্তর কোরীয় কূটনীতিক থায়ে ইয়ং হো, যিনি নিজেও পক্ষ ত্যাগ করেছিলেন, তিনি ২০১৯ সালে অসলো ফ্রিডম ফোরামে জানিয়েছেন, উত্তর কোরিয়া সরকারিভাবে মাদক চোরাকারবারের সাথে জড়িত। এবং সরকার সে দেশের মানুষের মধ্যে ব্যাপক মাদকাসক্তিকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে।
কিম বলছেন, ‘উত্তর কোরিয়ার সব অর্থের মালিক দেশটির সর্বোচ্চ নেতা। সেই টাকা দিয়ে তিনি প্রাসাদ তৈরি করেন, দামি গাড়ি কেনেন, পোশাক কেনেন এবং বিলাসী জীবন যাপন করেন।’
উত্তর কোরিয়ায় ১৯৯০-র দশক থেকে শুরু হওয়া খাদ্যাভাবে ৩০ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন বলে অনুমান করা হয়। কিম বলছেন, উত্তর কোরিয়ার আয়ের আরেকটি উৎস হচ্ছে ইরানের কাছে অবৈধভাবে অস্ত্র বিক্রি করা। এটিও দেখাশোনা করতো অপারেশনস ডিপার্টমেন্ট।
তার ভাষায়, ‘এই অস্ত্রের মধ্যে ছিল ছোট সাবমেরিন আর সেমি-সাবমারসিবল অসন্ত্র। এ ধরনের আধুনিক অস্ত্র তৈরিতে উত্তর কোরিয়া সিদ্ধহস্ত।’
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও উত্তর কোরিয়া ব্যাপক বিধ্বংসী মারণাস্ত্র তৈরির গবেষণায় বেশ এগিয়ে রয়েছে। গত সেপ্টেম্বর মাসে দেশটি চারটি নতুন অস্ত্রের পরীক্ষা চালায়।
এগুলো হচ্ছে দূর পাল্লার ক্রুজ মিসাইল, ট্রেন থেকে উৎক্ষেপণ করা যায় এমন ব্যালিস্টিক মিসাইল, হাইপারসনিক মিসাইল এবং বিমান বিধ্বংসী মিসাইল। এই কাজে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, তাও বেশ আধুনিক।
কিম বলছেন, দীর্ঘদিন গৃহযুদ্ধ চলেছে এমন বেশ কয়েকটি দেশে উত্তর কোরিয়া অস্ত্র এবং প্রযুক্তি বিক্রি করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জাতিসংঘ অভিযোগ করেছে যে, সিরিয়া, মিয়ানমার, লিবিয়া এবং সুদানে অস্ত্র সরবরাহ করেছে উত্তর কোরিয়া।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
টিএম