পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচির জনক হিসেবে পরিচিত আব্দুল কাদির খান রোববার সকালে মারা গেছেন। পাকিস্তানকে বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক অস্ত্রধারী ইসলামী শক্তিতে রূপান্তরিত করার জন্য তার প্রশংসা করা হয়। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব তাকে দুর্বৃত্ত দেশগুলোতে প্রযুক্তি পাচারের দায়ে ‌‘বিপজ্জনক বিশ্বাসঘাতক’ হিসেবে মনে করে।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন আব্দুল কাদির খান। রোববার সকালে দেশটির রাজধানী ইসলামাবাদের এক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৮৫ বছরে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এই পরমাণু বিজ্ঞানী।

পারমাণবিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে প্রতিবেশী ভারতের সমকক্ষ করে তোলা এবং দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ‘দুর্ভেদ্য’ করার জন্য তাকে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু ইরান, লিবিয়া ও উত্তর কোরিয়ার কাছে অবৈধভাবে পারমাণবিক প্রযুক্তি ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে নিজেকে বিতর্কের বেড়াজালে খুঁজে পান তিনি।

ওই তিন দেশে সম্প্রসারিত নেটওয়ার্ক চালানোর অভিযোগ স্বীকার করে নেওয়ার পর ২০০৪ সাল থেকে ইসলামাবাদে কার্যত গৃহবন্দি করে রাখা হয় তাকে। ২০০৬ সালে প্রস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি। তবে অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হয়ে ওঠেন।

২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশটির একটি আদালত তার গৃহবন্দি দশা অবসানের নির্দেশ দেন। কিন্তু তার গতিবিধি কঠোরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়। যখনই তিনি ইসলামাবাদে তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতেন, তখনই সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তার সঙ্গী হতেন।

গুরুত্বপূর্ণ অবদান

১৯৩৬ সালের ১ এপ্রিল ভারতের ভোপালে জন্মগ্রহণ করেন খান। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের শেষে ১৯৪৭ সালে রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মাধ্যমে উপমহাদেশের ভাগ হয়ে যাওয়ার সময় যখন তার পরিবার পাকিস্তানে চলে আসে তখন খান ছিলেন ছোট্ট এক কিশোর।

কাদির খান বলেছিলেন, পাকিস্তানকে একটি পারমাণবিক দেশ বানিয়ে আমি প্রথমবারের মতো বাঁচিয়েছি

১৯৬০ সালে করাচি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করেন তিনি। তারপর নেদারল্যান্ডস এবং বেলজিয়ামে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য যাওয়ার আগে বার্লিনে মেটালার্জিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করেন তিনি।

পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে ইউরেনিয়াম সেন্ট্রিফিউজের জন্য নকশা তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন তিনি; যা ইউরেনিয়ামকে পারমাণবিক ফিসাইল উপাদানের জন্য অস্ত্র-গ্রেড জ্বালানিতে রূপান্তরিত করে।

তবে তার বিরুদ্ধে এটি অ্যাংলো-ডাচ-জার্মান নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কনসোর্টিয়াম ‘ইউরেনকো’র জন্য কাজ করার সময় নেদারল্যান্ডস থেকে চুরি এবং ১৯৭৬ সালে তা পাকিস্তানে নিয়ে আসার অভিযোগ করা হয়েছিল। পাকিস্তানে ফিরে আসার পর দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো কাদির খানকে সরকারের নতুন সৃষ্ট ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন।

পরবর্তীতে একটি দৈনিক সংবাদপত্রকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে কাদির খান বলেছিলেন, ১৯৭৮ সালের মধ্যেই তার নেতৃত্বাধীন পরমাণু বিজ্ঞানীদের দল ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হন এবং ১৯৮৪ সালের মধ্যে তারা একটি পারমাণবিক অস্ত্র বিস্ফোরণের জন্য প্রস্তুত করে ফেলেন।

১৯৯৮ সালে পারমাণবিক পরীক্ষা চালানোর কারণে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার খড়গ নেমে আসে। এর ফলে দেশটির অর্থনীতিতে ধস শুরু হয়।

২০০১ সালের মার্চে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফের শাসনকালে কাদির খানের আভা ম্লান হতে শুরু করে। যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কারণে কাহুতা রিসার্চ ল্যাবরেটরির চেয়ার‌ম্যানের দায়িত্ব থেকে তাকে সরিয়ে বিশেষ উপদেষ্টার পদে বসানো হয়। পাকিস্তানের পারমাণবিক শক্তির নেপথ্যের কেউই কখনোই তাদের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় নায়ককে প্রশ্নবিদ্ধ করা হতে পারে আশা করেননি।

১৯৩৬ সালের ১ এপ্রিল ভারতের ভোপালে জন্মগ্রহণ করেন খান। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের বিভক্তির পর পরিবারের সঙ্গে পাকিস্তানে চলে যান তিনি

জাতিসংঘের নজরদারি কর্তৃপক্ষ আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) কাছ থেকে ইসলামাবাদ একটি চিঠি পাওয়ার পর ওই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। চিঠিতে পাকিস্তানি বিজ্ঞানীদের ‘বিকৃত পারমাণবিক জ্ঞানের উৎস’ বলে অভিযোগ করা হয়।

১৯৯০ সালে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সে দেওয়া ভাষণে কাদির খান বলেন, পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের সময় তিনি বিশ্ববাজারে লেনদেন করেছিলেন। তিনি বলেন, আমাদের পক্ষে দেশে এ ধরনের প্রত্যেকটি যন্ত্রপাতি তৈরি করা সম্ভব ছিল না।

‘আমি দেশ রক্ষা করেছি’

ওই স্বীকারোক্তির পর পারভেজ মুশাররফ কাদির খানকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু পরবর্তীতে নিজের মন্তব্য প্রত্যাহার করে নেন খান। ২০০৮ সালে গৃহবন্দি থাকাকালীন ফরাসি বার্তাসংস্থা এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে কাদির খান বলেন, পাকিস্তানকে একটি পারমাণবিক দেশ বানিয়ে আমি প্রথমবারের মতো দেশকে বাঁচিয়েছি। আমি আবারও দেশকে বাঁচিয়েছি এটি স্বীকার করার মাধ্যমে এবং এর পুরো দায় নিজে নিয়েছিলাম।

পারমাণবিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সেরা প্রতিরক্ষা হিসেবে বিশ্বাস করতেন পাকিস্তানের এই বিজ্ঞানী। ভারতের পরীক্ষার জবাবে ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। 

প্রায় এক দশক আগে রাজনীতিতে ভাগ্য পরীক্ষার চেষ্টা করেছিলেন কাদির খান। ২০১২ সালের জুলাইয়ে তেহরিক-ই-তাহফুজ পাকিস্তান (পাকিস্তান রক্ষা আন্দোলন) নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন তিনি। পাকিস্তানে তার যে সম্মান, শ্রদ্ধা আছে, তার ভিত্তিতে ভোটে জয়ের আশায় রাজনীতিতে নাম লেখান তিনি। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে দলের ১১১ প্রার্থীর কেউই জয় না পাওয়ায় এক বছর পর দলটি ভেঙে দেন তিনি।

২০০৬ সালে প্রস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তিনি। তবে অস্ত্রোপচারের পর সুস্থ হয়ে ওঠেন

একই বছর দেশটির উর্দু ভাষার দৈনিক ডেইলি জংকে কাদির খান সাক্ষাৎকার দেওয়ার পর নতুন এক বিতর্ক শুরু হয়। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, দেশটির নিহত সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর নির্দেশে তিনি অন্তত দুটি দেশে পারমাণবিক প্রযুক্তি স্থানান্তর করেছেন। তবে দেশ দুটির নাম তিনি বলেননি। দু’বারের প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোও ২০০৭ সালে হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আগে কখনোই এ বিষয়ে কথা বলেননি।

পাকিস্তানের এই পরমাণু বিজ্ঞানী বলেছিলেন, আমি স্বাধীন ছিলাম না। তবে প্রধানমন্ত্রীর আদেশ মেনে চলতে বাধ্য ছিলাম। ভুট্টোর রাজনৈতিক দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) খানের এই দাবিকে ‘ভিত্তিহীন ও অমূলক’ বলে অস্বীকার করে। বছরের পর বছর ধরে বিতর্ক চললেও খানের জনপ্রিয়তায় তেমন ভাটা পড়েনি।

প্রতিনিয়ত তিনি দেশটির জনপ্রিয় জং গ্রুপের সংবাদপত্রে নিবন্ধ লিখে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রচার করতেন। পাকিস্তানজুড়ে অনেক স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট এবং দাতব্য হাসপাতালের নামকরণ করা হয়েছে তার নামে।

সূত্র: এএফপি।

এসএস