কার হাতে উঠছে নোবেল শান্তি পুরস্কার
নোবেল শান্তি পুরস্কারকে বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ অর্জন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সুইডিশ বিজ্ঞানী, ব্যবসায়ী ও মানবহিতৈষী আলফ্রেড নোবেল যে ছয়টি পুরস্কারের প্রবর্তন করেছিলেন, নোবেল শান্তি পুরস্কার তারই একটি। গত সোমবার থেকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে পুরস্কার ঘোষণা করা হলেও ২০২১ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে আজ শুক্রবার (৮ অক্টোবর)।
২০২০ সালে মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কারটি পায় জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। অস্থিতিশীল ও সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন অঞ্চলে ক্ষুধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের স্বীকৃতি হিসেবে সংস্থাটিকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়। এ বছর মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কারটি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে উঠবে তা নিয়ে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে জল্পনা।
বিজ্ঞাপন
গত মঙ্গলবার (৫ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন জানায়, চলতি বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার জয়ের দৌড়ে রয়েছেন ৩২৯ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান। তবে চূড়ান্তভাবে এই পুরস্কার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও), রাশিয়ার বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনি, সুইডিশ পরিবেশ আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, বেলারুশের মানবাধিকার কর্মী সেভেতলানা তিখানোভস্কায়া বা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মধ্যে কারও হাতে উঠতে পারে বলে ধারণা করছে ম্যাগাজিনটি। শুক্রবার নরওয়ের রাজধানী অসলো থেকে এই পুরস্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। এরপর গত বছরের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) করোনাকে ‘বৈশ্বিক মহামারি’ হিসেবে ঘোষণা করে। এর আগে একই বছরের ২০ জানুয়ারি বিশ্বজুড়ে জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা করে সংস্থাটি।
বৈশ্বিক মহামারি ও জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণার পরও বিশ্বজুড়ে প্রায় সব দেশে ভয়ঙ্কর মহামারি রূপে ছড়িয়ে পড়ে করোনাভাইরাস। বিশ্বব্যাপী এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে পৌনে ২৪ কোটির ঘর। অন্যদিকে মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছে সাড়ে ৪৮ লাখে।
এই পরিস্থিতিতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় নানা বিধিনিষেধ ও পরামর্শ নিয়ে বিশ্বব্যাপী সক্রিয় ছিল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। এছাড়া কোভিড-১৯ টিকা আবিষ্কারের পর ধনী দেশগুলোর পাশাপাশি উন্নয়নশীল ও স্বল্পন্নোত দেশগুলোতে টিকা পৌঁছে দেওয়া এবং টিকাদান কর্মসূচি এগিয়ে নিতে সংস্থাটির ভূমিকাও অপরিসীম।
বিশ্বের সব দেশে করোনা টিকার ন্যায্য ও সমান বণ্টন নিশ্চিত করাকে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিচ্ছে ডব্লিউএইচও।
টাইম বলছে, ২০২০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার তালিকায় ডব্লিউএইচও’র নাম ছিল ওপরের দিকেই। জাতিসংঘেরই অন্য আরেক সংস্থা ডব্লিউএফপি’র কারণে তারা সেটি পায়নি। আর তাই চলতি বছর মর্যাদাপূর্ণ এই পুরস্কার পাওয়ার দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
অ্যালেক্সি নাভালনি
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কট্টর সমালোচক ও বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি নাভালনিকে চলতি বছর নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে রাশিয়ার বিরোধী এই নেতাকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেন নরওয়ের সাবেক মন্ত্রী ওলা এলভেসতুয়েন।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং তার প্রশাসনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নাভালনিকে শান্তিতে নোবেলের জন্য মনোনীত করা হয়েছে। এছাড়া রাশিয়ায় শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠায়ও কাজ করছেন শিক্ষাবিদ নাভালনি।
পুতিনের কট্টর সমালোচক এই শিক্ষাবিদ সাধারণ রুশ নাগরিকদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। আর এ জন্যই বার বার তার জীবন পড়েছে হুমকির মধ্যে। ২০২০ সালের আগস্ট মাসে বিমানে করে সার্বিয়া থেকে মস্কো যাওয়ার সময় চা পানের পরই অসুস্থ হয়ে কোমায় চলে যান নাভলনি। বিমানবন্দর থেকে তাকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
অবস্থার পরিবর্তন না হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে জার্মানি নেওয়া হয়। সেখানেই পরীক্ষায় জানায় যায়, সোভিয়েত আমলে তৈরি বিষাক্ত নার্ভ এজেন্ট নোভিচক দিয়ে তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল।
তবে সুস্থ হয়ে এরপরও আবার দেশে ফিরে যান পুতিনবিরোধী এই নেতা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে জার্মানি থেকে রাশিয়ায় ফিরে বিমানবন্দরেই পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন অ্যালেক্সি নাভালনি। একটি মামলায় স্থগিত দণ্ডের ‘শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে’ মস্কো বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতারের পর তিনি এখনও বন্দি জীবনযাপন করছেন।
গ্রেটা থুনবার্গ
জলবায়ু সংকট বর্তমান বিশ্বের অন্যতম বড় একটি সমস্যা। এই সংকট মোকাবিলায় বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে পরিণত হওয়া সুইডিশ পরিবেশ আন্দোলনকর্মী কিশোরী গ্রেটা থুনবার্গ পরিবেশ আন্দোলনের জন্য গড়ে তুলেছেন ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ নামের একটি সংগঠন। এই সংগঠনের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বিশ্ব নেতাদের সতর্ক করার পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন তিনি।
কিশোরী বয়সেই পরিবেশ আন্দোলনে যুক্ত হওয়া এবং জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরে পরিণত হওয়ায় ২০১৯ সালে টাইম ম্যাগাজিনের পার্সন অব দ্য ইয়ার নির্বাচিত হয়েছিলেন গ্রেটা থুনবার্গ। এরপর সেই বছর থেকেই নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাব্য একটি নাম হয়ে উঠেছেন তিনি। বিশ্লেষকদের ধারণা, চলতি বছর মর্যাদাপূর্ণ নোবেল শান্তি পুরস্কার পেতে পারেন কিশোরী এই পরিবেশকর্মী।
সেভেতলানা তিখানোভস্কায়া
চলতি বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ের দৌড়ে অন্যদের সঙ্গে এগিয়ে রয়েছেন বেলারুশের মানবাধিকার কর্মী ও রাজনীতিবিদ সেভেতলানা তিখানোভস্কায়া। গত বছর মে মাসে বেলারুশের বিরোধী নেতা সের্গেই তিখানোভস্কায়াকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেন দেশটির একনায়ক প্রেসিডেন্ট আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো। তবে স্বামীর গ্রেফতারের পর তার বদলে নির্বাচনে নিজেই প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন সেভেতলানা। এভাবেই একজন মা থেকে গণ-আন্দোলনের নেতায় পরিণত হন তিনি।
২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজেকে বিজয়ী ঘোষণা করেন ইউরোপের সর্বশেষ একনায়ক বলে খ্যাত আলেক্সান্ডার লুকাশেঙ্কো। যদিও ওই নির্বাচনে জালিয়াতি ও কারচুপির ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। এরপর শিশু সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে দেশ ছেড়ে পার্শ্ববর্তী লিথুয়ানিয়ায় পালিয়ে যান তিনি। সেখান থেকেই কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলের তথা নির্বাসিত সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন জো বাইডেন। উত্তরাধিকার সূত্রে আগের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মহামারি এবং রাজনৈতিকভাবে ব্যাপক বিভক্ত একটি দেশ।
কিন্তু দায়িত্ব নেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় বহুসংখ্যক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর মধ্যে ছিল- জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে ফের যোগ দেওয়া, যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণ বন্ধ করা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)-তে ফের অর্থ যোগান দেওয়া শুরু করা।
প্রেসিডেন্ট পদে থেকে নোবেল পুরস্কার জয়ের ঘটনা নতুন কিছু নয়। ২০০৯ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনের প্রথম বছরেই নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।
নরওয়ের আইনপ্রণেতারা ২০১৪ সাল থেকে যাদের মনোনয়ন দিয়েছেন; তাদের মধ্যে থেকেই প্রায় প্রত্যেক বছরই শান্তি পুরস্কার জয়ী পাওয়া গেছে। তবে এক্ষেত্রে শুধুমাত্র ২০১৯ সাল ব্যতিক্রম ছিল।
তবে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত বিজয়ী কারা হবেন সেবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন নরওয়ের নোবেল কমিটি। অবশ্য পুরস্কারের জন্য দেওয়া বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে মনোনয়নের ব্যাপারে তারা কোনো ধরনের মন্তব্য করেন না।
শুক্রবার শান্তিতে পুরস্কার ঘোষণার পর আগামী সোমবার (১১ অক্টোবর) অর্থনীতিতে চলতি বছরের নোবেল পুরস্কার জয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে।
টিএম