২০ হাজার বছর আগেও একবার এসেছিল করোনা মহামারি
এখনকার মানুষদের জিনোম নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা প্রাচীনকালে করোনা ভাইরাসের একটি প্রাদুর্ভাবের ইঙ্গিত পেয়েছেন। এ ধরনের গবেষণা থেকে অতীতে মহামারির জন্য দায়ী কোনো ভাইরাসকে যেমন চিহ্নিত করা যায়, তেমনি ভবিষ্যতে কোন ভাইরাস সম্ভাব্য মহামারির কারণে হতে পারে, সে সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া সম্ভব।
নতুন এ গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখছেন, আজ থেকে ২০ হাজার বছর আগে পূর্ব এশিয়াতে মহামারি আকারে ছড়িয়েছিল করোনা ভাইরাস (এটি বর্তমানে ছড়িয়ে পড়া নভেল করোনা ভাইরাস নয়)। ওই অঞ্চলের মানুষের জেনেটিক মেকআপে এর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
কারেন্ট বায়োলজিতে গবেষণা প্রতিবেদনটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এ গবেষণার জন্য বিজ্ঞানীরা আধুনিক কালের আড়াই হাজার মানুষের জিনোম বিশ্লেষণ করেছেন। আগেও করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর মানুষ কিভাবে ওই ভাইরাসগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলেছিল, সেটা সম্পর্কে ধারণা পেতে এ গবেষণা করা হয়। এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত আছেন ইউনিভার্সিট অব অ্যারিজোনা ও ইউনিভার্সিট অব অ্যাডিলেইডের গবেষকরা। করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা অর্জনের প্রক্রিয়াটা বোঝার জন্য তারা কম্পিউটারের সাহায্য নিয়েছেন। এবারের এই করোনা (কোভিড-১৯) মহামারিসহ গত ২০ বছরে ভাইরাস পরিবারের যে অংশটি তিনটি বড় প্রাদুর্ভাব ঘটিয়েছে সেটা হলো করোনাভাইরাস।
গত ২০ বছরে তিনবার করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে। এরমধ্যে ২০০২ সালে চীন থেকে ছড়িয়ে পড়ে সার্স-কভ থেকে সৃষ্ট রোগ সেভার অ্যাকিউট রেসপাইরেটরি সিন্ড্রোম, এতে ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়। মার্স-কভ থেকে ছড়িয়ে পড়ে মিডল ইস্ট রেসপাইরেটরি সিন্ড্রোম, এতে মারা যায় ৮৫০ জন। আর সার্স-কভ-২ থেকে ছড়িয়ে পড়েছে কোভিড-১৯। এতে এখন পর্যন্ত ৩৮ লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন।
জিনোম বলতে কোন জীবের সামগ্রিক ডিএনএকে বোঝায়। একে সহজভাবে বলা চলে জীবনের নীলনকশা বা কোন জীবের জীবন-বিধান। জীবের বৃদ্ধি, প্রজনন, পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়া সহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে জিনোম।
ভাইরাসের বিবর্তনের এই গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীরা এখন জানতে পারছেন যে হাজারো বছর আগেও করোনা ভাইরাস একবার মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছিল।
এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত একজন অধ্যাপক বলছেন, ব্যাপারটা অনেকটা এরকম যে সরাসরি ডাইনোসরের দেহাবশেষের জীবাশ্মের বদলে তার একটা পদচিহ্ন পেলাম আমরা। আমরা সরাসরি প্রাচীন এ ভাইরাসের অস্তিত্ব পাইনি, কিন্তু আমরা দেখেছি যে, বহু বছর আগে মহামারির সময় মানব জিনোমে কী চিহ্ন রেখে গেছে এই ভাইরাস।
গবেষক দল জীবিত কোষ ব্যবহার না করে মানুষ ও সার্স-কোভ-২ এর প্রোটিন সংশ্লেষ করেছেন। এতে তারা দেখেন যে, এটা সরাসরি একটা মিথষ্ক্রিয়া ঘটাচ্ছে। পুরো এ প্রক্রিয়াটার সঙ্গে করোনাভাইরাস যেভাবে মানবশরীরের কোষে আক্রমণ করে তার মিল রয়েছে। আধুনিক যুগের মানুষের জিনোম থেকে এখনও হাজারো বছরের পুরোনো বিবর্তনমূলক তথ্য পাওয়া যায়। এসব তথ্যের মধ্যে রয়েছে- ভাইরাসসহ অন্য আরও বিপদগুলোর বিরুদ্ধে শারীরিক ও মানসিকভাবে মানুষ কিভাবে প্রতিরোধী বা সহিষ্ণু হয়ে উঠল তার ইতিহাস।
গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে এখনকার পূর্ব এশিয়ানদের পূর্বসূরীরা করোনা ভাইরাস থেকে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ এর মতো একটি রোগের মহামারির মুখে পড়েছিল। এখন যা চীন, জাপান, মঙ্গোলিয়া, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ান সেখানেই মূলত পূর্ব এশিয়ানদের পূর্বসূরীদের বাস ছিল।
কোনো ভাইরাস যদি কোনো কোষকে আক্রমণ করতে চায়, তবে তাকে অবশ্যই তার হোস্ট সেল থেকে উৎপাদিত প্রোটিনের সঙ্গে হাত মেলাতে হবে। এই প্রোটিনগুলোকে ভাইরাল ইন্টারেক্টিং প্রোটিন বা সংক্ষেপে ভিআইপি বলা হয়। মানবশরীরে এমন ৪২টি ভিন্ন জিন বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন, যেগুলো এই ভিআইপির সাথে মিথষ্ক্রিয়ায় সক্ষম। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, আধুনিক পূর্ব এশিয়ানদের পূর্বপুরুষরা আজ থেকে ২০ হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে প্রথম করোনা ভাইরাসের মুখোমুখি হয়েছিলেন।
গবেষণার প্রধান লেখক ইয়াসিন সুউলমি বলছেন, করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় ফুসফুসের টিস্যুর। আর সেই ফুসফুসেই আমরা ৪২টি ভিআইপি সক্রিয় অবস্থায় থাকতে দেখছি। এগুলো একেবারে সরাসরি ভাইরাসের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে।
হোস্ট সেলের পৃষ্ঠে থাকা ভিআইপিকে ব্যবহার করেই করোনা ভাইরাস নির্দিষ্ট কোনো কোষের ভেতরে ঢুকে পড়ে। আর একবার সে ভেতরে ঢুকতে পারলে আরও অনেক সেলুলার প্রোটিনের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া শুরু করে সে।
জিনোমের পুরোটাই জিন নয়, বরং জিন-এর একটি অংশ মাত্র। জিন বলতে জিনোমের সেই অংশকে বোঝানো হয়, যা নির্দিষ্ট কোন প্রোটিন তৈরির কোড ধারণ করে। যেমন, মানুষের শরীরে তিন বিলিয়ন জোড়া বেইসের মধ্যে জিন রয়েছে মাত্র ২০ হাজারের মতো। এই জিনগুলো সম্মিলিতভাবে মানবের সকল বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।
গবেষক দলের একজন বলছেন, মানবশরীরের যে জিনগুলোর ভাইরাসকে ঠেকিয়ে দেওয়ার কথা বা তাদের বংশবৃদ্ধিতে সহায়তা করার কথা সেই জিনগুলোকে স্বাভাবিকভাবে যতটা কার্যকরী ভূমিকায় থাকার কথা, ২৫ হাজার বছর আগে থেকেই এরা তার চেয়ে বেশি কার্যকরী ভূমিকা রেখে আসছে।
এ গবেষণা থেকে আরও দেখা যাচ্ছে, মহামারি চলতে থাকা সময়েই ভাইরাস-কোষের এই মিথস্ক্রিয়া থেকেই একটি রোগটি ধীরে ধীরে দূর্বল হয়ে পড়ে। প্রাচীন ভাইরাসগুলোর রেখে যাওয়া এই পদাঙ্ক থেকেই বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করছেন কিভাবে অঞ্চলের মানুষেরা ভাইরাসগুলোর বিরুদ্ধে সহ্যক্ষমতা গড়ে তুলেছে শরীরে।
অন্যান্য আরও কিছু গবেষণা থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ভিআইপি জিনে মিউটেশন করোনা ভাইরাসের সংবেদনশীলতা ও কোভিড-১৯ এর উপসর্গের ওপর প্রভাব রাখতে পারে। এমন কিছু ভিআইপি নিয়েই বর্তমানে কোভিড-১৯ এর ওষুধ তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
গবেষকরা বলছেন, সুদূর অতীতে মহামারির জন্য দায়ী ভাইরাসগুলোকে চিনতে সহায়ক হবে তাদের গবেষণা। আবার ভবিষ্যতে কোন ভাইরাস থেকে মহামারি হতে পারে তারও ইঙ্গিত পাওয়া যাবে এ গবেষণা থেকে। আবার অতীতের কোনো ভয়াবহ ভাইরাস যদি আবার নতুন করে ফিরে আসে তবে তার চিকিৎসা বা ওষুধ তৈরিতে কী করা যাবে, সে বিষয়েও একটা অবদান রাখবে এই গবেষণা।
সাইটেক ডেইলি থেকে অনুবাদ নাঈম ফেরদৌস রিতম।
এনএফ