এ পৃথিবীর কোনো এক অঞ্চলে বাস করে ৬ বছরের শিশু আদ্রিয়ানা। বাকি সব শিশুদের মতোই আদ্রিয়ানা যখন হাসে স্বর্গীয় এক আভা ফুটে ওঠে তার মুখে। ফুটফুটে আদ্রিয়ানা ফুটবল খেলতে ভালোবাসে, ছবি ও লাইব্রেরিও তার পছন্দ। আদ্রিয়ানার স্বপ্ন বড় হয়ে সে বিজ্ঞানী হবে। বিজ্ঞানী হয়ে আদ্রিয়ানা এমন একটা রোবট তৈরি করবে যে রোবট দূষিত বায়ু পরিষ্কার করে ফেলতে পারবে। মোট কথা আদ্রিয়ানা বড় হয়ে এমন একজন মানুষ হতে চায় যে এই পৃথিবীর উপকারে আসবে।  

কিন্তু আদ্রিয়ানার মতো এমন স্বপ্ন দেখা মানুষগুলোর জন্য স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠাটা দিন দিন কঠিন হয়ে যাচ্ছে মানুষেরই নানা কাজের কারণে। নানা প্রজন্মের মানুষের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ বিষয়টা উঠে এসেছে। এই প্রথম এ ধরনের কোনো গবেষণা করা হলো।   

এই গবেষণায় বলা হয়েছে, বর্তমানে যে হারে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ছে, তা যদি চলতে থাকে, তাহলে এখনকার এই ৬ বছরের আদ্রিয়ানাকে তার দাদা-দাদির তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে মোকাবিলা করে বাঁচতে হবে। আদ্রিয়ানাদের প্রজন্মকে ১৯৬০ সালে জন্ম নেওয়া কারো চেয়ে দ্বিগুণ দাবানল, দেড় গুণের বেশি ঘূর্ণিঝড়, প্রায় সাড়ে ৩ গুণ বন্যা, আড়াইগুণ বেশি ফসল নষ্ট হওয়া এবং ২.৩ গুণ বেশি খরার মুখে পড়তে হবে। 

গবেষণার এসব তথ্য চলতি সপ্তাহে সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এতে প্রধান গবেষক উইম থিয়েরি দেখেছেন একটি প্রজন্ম থেকে আরেকটি প্রজন্ম কিভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।  

গবেষণায় অংশ নেন থিয়েরি ও তার ৩৬ জন সহকর্মী। জলবায়ু এবং জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বেশ কিছু মডেলের আলোকে তারা তুলনা করেছেন গত প্রজন্মের তুলনায় আজকের শিশুরা তাদের জীবদ্দশায় কত বেশি জলবায়ুকেন্দ্রীক হুমকির মধ্যে রয়েছেন। গবেষকরা বলছেন, এই শিশুরা যদি আজ থেকে ১৫০ বছর আগের মানুষ হতো তবে তাদের যত প্রাকৃতির দুর্যোগের মুখে পড়তে হতো, এখন পড়তে হবে তার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি। 

উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ পরিবর্তনের ধারা আরও অনেক বেশি। সাব-সাহারা আফ্রিকার একটি শিশুকে শিল্পায়নের আগে জন্ম নেওয়া কোনো শিশুর তুলনায় ৫০ থেকে ৫৪ গুণ বেশি তাপপ্রবাহের মধ্যে বাঁচতে হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। 

থিয়েরি বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য পৃথিবীর যেসব অঞ্চলের দায় সবচেয়ে কম, বৈশ্বিক নীতি নির্ধারণে যাদের ভূমিকা নেই বললেই চলে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাদেরই সবচেয়ে বেশি ভুগতে হবে। বায়ুমণ্ডলে বর্তমানে  যে পরিমাণ গ্রিনহাউজ গ্যাস রয়েছে, এর অর্ধেকের বেশি তৈরি হয়েছে ১৯৯০ সালের পর। এর অর্থ হলো আজকের শিশুরা ভবিষ্যতে যে ধ্বংসযজ্ঞের মুখে পড়বে, তার সাথে তাদের বাবা-মায়ের জীবদ্দশার সময়ের কার্বন নিঃসরণের সম্পর্ক থাকতে পারে। 

তিনি আরও বলছেন, জলবায়ু সংকটের ধকলটা আজকের তরুণদের ওপর দিয়েই যাবে, কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। আর যাদের ক্ষমতা আছে এখানে একটা পরিবর্তন আনার, তাদের এসবের ফল ভোগ করতে হবে না।  

তিনি আরও বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়াসহ উষ্ণায়নের জন্য দায়ী কর্মকাণ্ডগুলো বন্ধ করা গেলে এখনও ভবিষ্যতের শিশুদের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। উষ্ণায়নের হার যদি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ভেতর রাখা সম্ভব হয় তাতেও আজকের নবজাতকের তীব্র তাপ প্রবাহের মুখে পড়ার আশঙ্কা অর্ধেকে নেমে আসবে। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ার শঙ্কাও তাদের জন্য কমে আসবে।  

কিন্তু এখনও ১.৫ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। এ মাসের শুরুর দিকে প্রকাশিত জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে, জলবায়ু নিয়ে বিভিন্ন দেশ এখনও পর্যন্ত যেমন অঙ্গীকার দিয়ে রেখেছে তাতে দেখা যাচ্ছে, এ দশকের শেষ নাগাদ গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ ১৬ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। আর তার ফলে শতাব্দীর শেষ নাগাদ বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে ঠেকতে পারে।  

এসব খবর আদ্রিয়ানাকে ভাবিয়ে তুলছে। সে এরইমধ্যে ক্যালিফোর্নিয়ার দাবানল নিয়ে উদ্বিগ্ন। খবরে সে দেখেছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বিভিন্ন দ্বীপ ডুবে যাচ্ছে। হ্যারিকেন  ও খরার খবরও নিয়মিত শুনছে সে।  

আদ্রিয়ানার ভাষায়, বড়রা কোনো কথাই শুনতে চায় না। তারা যেটা করছে, সেটা করতেই থাকবে আর পৃথিবীকে আরও উষ্ণ করে তুলবে। যতদিন না আমি বড় হচ্ছি সবকিছু খারাপ হতেই থাকবে। কাউকে না কাউকে তো কিছু করতে হবে। 

যে গবেষণার আলোকে এসব অবস্থা মানুষের নজরে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে সেই গবেষণার অনুপ্রেরণা মূল লেখক থিয়েরি কিছুটা পেয়েছেন তার ৭, ৫ ও ২ বছর বয়সী তিন ছেলে থেকে। কিন্তু গবেষণার বিষয়বস্তু শিশুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তিনি বলছেন, ৪০ বছরের  কম বয়সী যে কাউকেই এখন নজিরবিহীন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে পড়তে হবে। শিল্পবিপ্লব-পূর্ববর্তী বিশ্বে যেখানে ১০ হাজার ভাগের ১ ভাগ সম্ভাবনা ছিল ভয়াবহ কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের, এখন ৪০ বছরের কম বয়সীদের এমন দুর্যোগের মুখে পড়তে হবে।  

তিনি আরও বলেন, শুরুর দিকে সবাই বলতো যে, হ্যাঁ, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন কমাতে হবে। না হলে আমাদের নাতি-নাতনিরা…. এই গবেষণা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের সেই সময়টা চলে এসেছে, সবখানেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়।  

গবেষণার সহ-লেখক জোয়েরি রগলেজ বলছেন, এই যে পরিবর্তন আসছে, এর সাথে দেশগুলোকে খাপ খাওয়াতে হবে। মানুষের নিরাপত্তার কথা ভেবে যদি এখন থেকে বিনিয়োগ করা যায়, উদাহরণস্বরুপ: যদি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরিতে বিনিয়োগ করা যায়, ভবন নির্মাণে অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টি মাথায় রাখা যায়, ভয়াবহ তাপপ্রবাহের ঝুঁকিতে থাকাদের জন্য কার্যকর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা যায়, তবে হয়তো দুর্যোগগুলো এখনকার মানুষের জন্য যেমন ভয়ঙ্কর, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য অতটা ভয়ঙ্কর হবে না। এখনই এ বিষয়ে কোনো উপসংহারে পৌঁছানো আমাদের উদ্দেশ্য নয়, বরং আজ যে শিশুর জন্ম হচ্ছে তার জন্য এখনকার অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোই আমাদের উদ্দেশ্য। 
জলবায়ু বিজ্ঞানী কিম কব এ গবেষণার প্রশংসা করেছেন। একইসঙ্গে তিনি এ কথাও বলেছেন যে, তিনি মোটেও অবাক হননি। 

এই কিম কব চার সন্তানের মা। একজন মায়ের চোখে থেকে তিনি যখন সবকিছু দেখছেন তখন কিছুটা ভিন্ন পরিস্থিতি দেখছেন তিনি। তিনি বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বহু অর্থনৈতিক মডেল এ সমস্যাটা ধরতে পারে না। সমস্যাটা হলো- এই দশকে আমরা কার্বন নিঃসরণের মাত্রা যেটা রাখবো, তার ওপর নির্ভর করবে বহু মানুষের ভাগ্য। 

নৈতিকভাবে এ সময়টা মূল্য নির্ধারণ সম্ভব নয় বলেও মনে করেন তিনি। 

থিয়েরির এ গবেষণার সাথে সমন্বয়ে করে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সেভ দ্য চিলড্রেন বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের যে লক্ষ্য রয়েছে তা পূরণে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে।  একইসঙ্গে নিম্ন আয়ের দেশগুলো যাতে কার্বন নিঃসরণ কমাতে পারে এবং ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামনে আসা প্রভাবগুলোর সাথে মোকাবিলা করতে পারে, সে জন্য ধনী দেশগুলোর বছরে তাদের যে ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে, সেটা যেন ধনী দেশগুলো পূরণ করে সে জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।  

তরুণরা এখনই বলছে, যে তারা জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার এবং এটা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে।  

সম্প্রতি ১৬ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের মধ্যে চালানো এক জরিপে বিজ্ঞানীরা পেয়েছেন, চারভাগের তিন ভাগ তাদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কায় রয়েছেন আর অর্ধেকের বেশি মনে করেন তারা নিজেদের বাবা-মায়ের চেয়ে কম সুযোগ-সুবিধা পাবেন। প্রায় ৬০ শতাংশ মনে করেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের সাথে ও ভবিষ্যত প্রজন্মের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। এ বিষয়টা তাদের উদ্বগ আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। 

নরওয়ের ১৪ বছরের একজন পরিবেশকর্মী ইমানুয়েল এসমারির ভাষায়, তার জন্য ও অন্য আরও অনেকের জন্য ভবিষ্যতটা এখন অনিরাপদ। রাজনীতিবিদ ও যাদের হাতে ক্ষমতা আছে তারা যখন কিছুই না করে চুপ থাকে, তখন নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগে।  

গবেষক থিয়েরি বলছেন, এখন আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য কেমন পৃথিবী রেখে যাবো। এখনও খারাপটা ঠেকানো সম্ভব। বাবা হিসেবে এই এটুকুই এখনও আমাকে শক্তি দেয়। ওদের ভবিষ্যতটা আমাদের হাতেই। 

অনুবাদ : নাঈম ফেরদৌস রিতম। 

এনএফ