ব্রিটেনে স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত সবকিছুর নজর এখন করোনাকেন্দ্রীক। আর এর মধ্যেই দ্বিতীয় একটি স্বাস্থ্য সংকট ঘণীভূত হচ্ছে সেখানে। চলতি বছরের জুলাইয়ের শুরু থেকে স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েক হাজার বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আর এসব মৃত্যুর জন্য করোনা ভাইরাস দায়ী নয়।    

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রীষ্মে এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। শীতের মৌসুমে নানা কারণে মৃত্যুহার অন্য সময়ের চেয়ে বেশি থাকে, কিন্তু গ্রীষ্মে সাধারণত মৃত্যুহার কম থাকে। 

তবে এ বছরের সার্বিক পরিস্থিতি অন্যরকম যাচ্ছে। 

অফিস ফর ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকসের তথ্য অনুযায়ী, ২ জুলাইয়ের পর ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৯ হাজার ৬১৯ জনের বেশি মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে ৪৮ শতাংশের মৃত্যু করোনায় আক্রান্ত হয়ে নয়, বরং অন্য কোনো কারণে হয়েছে। 

এই যে অতিরিক্ত মানুষের মৃত্যু হলো তাদের মৃত্যু যদি করোনার কারণে না হয়ে থাকবে, প্রশ্ন উঠেছে তাহলে তাদের মৃত্যু হলো কোন কারণে।  
পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ডের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় সাড়ে ৪ হাজার মৃত্যুর জন্য দায়ী নানা ধরনের হৃদরোগ ও স্ট্রোক। আর বাকিরা মারা গেছেন অন্যান্য নানা রোগে। এছাড়া জুলাইয়ের শুরু থেকে এ পর্যন্ত শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণের তথ্যও বেশি পাওয়া গেছে ডেথ সার্টিফিকেটে। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশি মৃত্যুর তথ্য পাওয়া গেছে, মূত্রনালীর রোগ, লিভার জটিলতায় ও ডায়াবেটিসের কারণে। 

এ ধরনের নানা জটিলতার রোগ নির্ণয়ই আসলে ২০২০ সালে কম হয়েছে। রোগ নির্ণয়ের হারে এত বড় পতন এর আগে দেখা যায়নি।  মূলত গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থা এখন মহামারিকেন্দ্রীক হয়ে যাওয়ার কারণে এ অবস্থার তৈরি হয়েছে। 

গত সপ্তাহে যুক্তরাজ্য সরকার যে তথ্য দিয়েছে সেখানে দেখা যাচ্ছে, বিশেষজ্ঞ নয় এমন চিকিৎসকের পরামর্শ ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে ২ কোটি ৩০ লাখ কম মানুষ নিয়েছেন।  ফলশ্রুতিতে বহু মানুষ হৃদরোগ, ডায়াবেটিসহ নানা রোগে আক্রান্ত হলেও সেসব রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। 

মহামারির শুরু থেকে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) ব্যস্ত থেকেছে করোনা মোকাবিলায়। এজন্য তাদের বারবার সতর্কও করা হয়েছে যে, অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা পেতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।  

সেই ১৮ মাসের দেরির খেসারত হয়তো এখন দিতে হচ্ছে যুক্তরাজ্যকে। 

একজন চিকিৎসক বলছেন, এখন দেখা যাচ্ছে যে রোগীরা হাসপাতালে আসছেন, তাদের অবস্থা গুরুতর। মহামারির সময়টাতে অন্য রোগে আক্রান্ত এই রোগীরা তাদের রোগ আরও জটিল করে তারপর হাসপাতালে আসছেন। 

একইসঙ্গে তিনি এ বলেও সতর্ক করে দিযেছেন যে, এ বছর হয়তো ফ্লুতে আক্রান্তের হারও বেশি থাকবে। কারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রতিরোধ ক্ষমতা এ বছরে কম থাকবে মানুষের।  

এই চিকিৎসক আরও বলেছেন, রোগীর অবস্থা এমন হয়েছে যে, দেখে মনে হচ্ছে এখন শীত চলছে। কিন্তু আসলে তো শীত কেবল আসছে। আমার মনে হয় অবস্থা এখন ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ।  

এনএইচএসের হাতে যে তথ্য রয়েছে তাতে তারা ধারণা করছে, এখন প্রায় ৫০ লাখ মানুষ চিকিৎসা নেওয়ার জন্য অপেক্ষায় আছেন। আর দেশটির স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, এ সংখ্যা ১ কোটি ৩০ লাখ ছাড়াতে পারে। 

২০২০ সালের অক্টোর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ব্রিটেনে অস্ত্রোপচার সংক্রান্ত এক-চতুর্থাংশ কার্যক্রম শেষ পর্যন্ত আর হয়নি। ওই সময় প্রতি পাঁচটা অপারেশন থিয়েটারের একটা বন্ধ হয়ে যায়, অ্যানেসথেশিয়ার কাজে জড়িত প্রতি আটজনের একজন তাদের নিয়মিত ডিউটিতে উপস্থিত ছিলেন না। 

এছাড়া করোনা আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ও করোনাকালে চিকিৎসা কেমন হবে তা নিয়ে দ্বিধা থেকে ১৫ লাখের বেশি জরুরি ভর্তি পিছিয়ে যায়। 
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় স্বল্পতার কারণেও ভুগতে হচ্ছে যুক্তরাজ্যকে। লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, আইসোলেশন, মাস্ক ইত্যাদি কারণে কোভিড সংক্রমণের হার একদিকে যেমন কমেছে এর সাথে সাথে অন্যান্য আরও অনেক রোগের বিস্তারও তা কমিয়েছে। 

চলতি বছরের ১১ জুলাই পর্যন্ত আগের ৫২ সপ্তাহের একটা অবস্থা বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, মাম্পস, রুবেলা, ইয়েলো ফিভার সংক্রমণের হার মহামারি পূর্ববর্তী আগের পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।  

কিন্তু আশঙ্কার কথা হলো যেহেতু এ কারণে মানুষের শরীরে প্রতিরোধ ক্ষমতা স্বাভাবিকের চেয়ে কম আছে, তাই এ বছর শীতে সংক্রামক নানা রোগ ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে। সেটা স্বাস্থ্য  ব্যবস্থার ওপর বাড়তি চাপ ফেলবে ফলে দেখা যাবে আবারও মাস্ক বাধ্যতামূলক হওয়াসহ নানা বিধিনিষেধ আবার ফিরে আসবে। 

আর সেটা হলে দেখা যাবে যুক্তরাজ্য প্রতি শীতের জন্য দুর্বল-প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন একটি দেশে পরিণত হবে যেখান থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হবে। 

সূত্র : দ্য টেলিগ্রাফ। 

এনএফ