ভেঙে দেওয়া বাড়িঘর আবার তোলার চেষ্টায় গ্রামবাসীরা

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় আসাম রাজ্যের দরং জেলায় একটি শিবমন্দির নির্মাণের লক্ষ্যে হাজার হাজার বাঙালি মুসলিমকে তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করার পর বৃহস্পতিবার সেই আশ্রয়চ্যুতদের বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালিয়েছে। পুলিশের গুলিতে অন্তত দুজনের মৃত্যু ও আরও বেশ কয়েকজনের আহত হওয়ার খবর জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিকরা।

রাজ্যের বিরোধী দল কংগ্রেসের সভাপতিও এই হত্যাকাণ্ডের খবর টুইট করেছেন। দরং জেলার ধলপুর গ্রামে একটি প্রাচীন শিবমন্দিরকে অনেক বড় আকারে গড়ে তোলার লক্ষ্যে গত কয়েক মাস ধরেই আসাম সরকার সেখানে দফায় দফায় উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে, যদিও সেই ভিটেমাটি-হারানোরা দাবি করছেন তাদের সব ধরনের সরকারি নথি ও পরিচয়পত্রই আছে।

বস্তুত আসামের দরং জেলার ধলপুর হিলস ও সিপাহঝাড় এলাকায় প্রায় ৭৭ হাজার বিঘা জমি দখল করে বিশাল একটি শিবমন্দির কমপ্লেক্স বানানোর লক্ষ্যে রাজ্য সরকার সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে বেশ কয়েক মাস ধরেই।

সেই অভিযানের সবশেষ ধাপে গত সোমবার ওই অঞ্চলের বাসিন্দা প্রায় আটশো পরিবারের বেশ কয়েক হাজার মানুষকে তাদের ভিটে থেকে উচ্ছেদ করে সেই জমি খালি করিয়ে দেওয়া হয়। তার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার দরংয়ে উচ্ছেদ-বিরোধী কমিটির জমায়েতে পুলিশ গুলি চালালে অনেকে হতাহত হন।

স্থানীয় সাংবাদিক দেবব্রত দত্ত জানিয়েছেন, ‘উচ্ছেদের বিরুদ্ধে যে সেল গড়ে তোলা হয়েছে তাদের ডাকে ধলপুর ১, ২ ও ৩ নম্বর গ্রামের বেশ কয়েক হাজার মানুষ আজ জড়ো হয়েছিলেন - সেখানে পুলিশের হামলায় অন্তত ১০ জন ব্যক্তি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে আমরা জানতে পারছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘তাদের মধ্যে অন্তত দু’জন নিহত হয়েছেন, একজনের লাশের ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি ওখানে অগ্নিগর্ভই ছিল, স্থানীয় নেতারা গতকালই আমাকে বলছিলেন তাদের লড়াই তারাই লড়বেন - বিরোধী কংগ্রেস বা এআইডিইউএফ নেতারা ঢুকতে গেলে পেটাবেন এবং কোনও রাজনীতি করতে দেবেন না।’

বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ আসামের কংগ্রেস প্রধান ভূপেন কুমার বোরা এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন। তবে তখনও পুলিশ বা রাজ্য সরকার গুলি চালনার কথা স্বীকার করেনি। নিহত একজনের ছবিও টুইট করেন কুমার বোরা।

এদিকে ঘটনাস্থল ঘুরে এসে দেবব্রত দত্ত জানান, এই উচ্ছেদ হওয়া মানুষরা প্রায় সবাই বাঙালি মুসলিম যারা বহু দশক ধরে ধলপুরের চরাঞ্চলেই বসবাস করছেন।

রহিমা শেখ নামে সেখানকার এক বাসিন্দা বলছেলেন, ‘নদীর বুকেই বারবার ঘর বাঁধি আর সেই নদীর বুক থেকেই বারবার আমাদের খ্যাদায়ে দেয়। অথচ আমাদের কাগজপাতি সব আছে - এনআরসি, প্যান কার্ড। নিজেরা খাই বা না-খাই সরকারি খাজনা ঠিকই দিয়ে যাচ্ছি।’

তার ভাষায়, ‘সেই ১৯৮৩ সালেরও কত আগে থেকে আমরা এখানে থাকতেসি। তহন এইহানে মন্দির-টন্দির কিসুই আসিল না, ছোট্ট একটা পাহাড় আসিল শুধু!’

পাশ থেকে জাহানারা বেগম নামে এক নারী বলেন, ‘রাত জেগে আমরা ঘর বানায়ছিলাম। আমরা দুখিয়া মানুষ ... এখন মন্দিরের দাবি কইর‍্যা আমাগো খ্যাদায় দিল।’

আর এক গ্রামবাসী হাসনু আরাও কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘বড়ো দুঃখু পাইসু। আমি এতিয়া ... মাটিবাড়ি নাই ... এখন কইত যাম?’

এদিকে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সেলের নেতা নিয়ামত শেখ বা জাহাঙ্গীর আলমরাও জানাচ্ছেন, তারা প্রত্যেকে দেশের বৈধ নাগরিক ও বহু বছর ধরে সরকারি খাজনা দিয়ে আসছেন ... তারপরেও তারা বিজেপির রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার।

নিয়ামত শেখ যেমন নিজের দাবির স্বপক্ষে ২৬ আগস্ট, ১৯৮৪ তারিখে দেওয়া একটি খাজনার রসিদও তুলে ধরেন। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, উচ্ছেদ হওয়া প্রত্যেকের এনআরসিতে নাম আছে। লিগ্যাসি ডেটা আছে। এই অঞ্চলে বহু সরকারি প্রাথমিক স্কুল আছে - অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র আছে। তারপরেও কীভাবে আমরা অবৈধ হই?

গোটা বিষয়টিকে চরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের ওপর বিজেপির ‘নির্মম অত্যাচার’ হিসেবেই দেখছেন তিনি। যে ঘোষিত উদ্দেশ্য নিয়ে সরকার এই উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে, সেটা হল ওই এলাকার একটি প্রাচীন শিবমন্দিরকে নতুন করে গড়ে তোলা।

শিবমন্দিরটি বড়জোর তিন-চারশো বছরের পুরনো বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা এবং আসামের একটি নামী নিউজ পোর্টালের সম্পাদক আফরিদা হুসেইন মনে করেন এখানে আর যাই হোক - সরকারের উদ্দেশ্য সৎ নয়।

তিনি বলছিলেন, ‘সরকারের উদ্দেশ্যকে আমি সঠিক বলতে পারব না - সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে খুশি করতেই এই সব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। আমি নিজে ধলপুরে গেছি, কিন্তু সেই মন্দির সুপ্রাচীন যুগের - এমন কোনো প্রমাণই পাইনি।’

তার ভাষায়, ‘তা ছাড়া মন্দিরটিকে ঘিরে হাজার হাজার মুসলিম পরিবার বহু বছর ধরে বাস করছে, আগে কোনোদিন অশান্তি হয়নি। এমন কী মন্দির কর্তৃপক্ষ বহু মুসলিম পরিবারকে চাষবাস ও খামার করার জন্য জমিও দিয়েছিল।’

গত জুন মাসে প্রথম দফা উচ্ছেদের পর আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ঘটনাস্থল পরিদর্শনেও যান। ফিরে এসে তখন তিনি টুইট করেন, ধলপুর শিবপুরের কাছে বিস্তীর্ণ এলাকা কীভাবে অবৈধ বসতিস্থাপনকারীরা দখল করে রেখেছিল তা আমি সরেজমিনে দেখে এসেছি!

সূত্র: বিবিসি বাংলা

টিএম