মিয়ানমারে যেসব ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে রোহিঙ্গাবিরোধী উস্কানি দেওয়ার পর তা মুছে ফেলা হয়েছে, সেসব কন্টেন্ট আদালতে জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জজ আদালতের একজন বিচারক।

ফেসবুক কর্তৃপক্ষ অবশ্য প্রথম পর্যায়ে এই নির্দেশের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে। এ বিষয়ে বিশ্বের সর্ববৃহৎ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফরটির বক্তব্য- এই নির্দেশ পালন করা হলে তা যুক্তরাষ্ট্রের ইলেকট্রনিক কমিউনিকেশন বিষয়ক যে আইন রয়েছে, তার লঙ্ঘন হবে।

তবে জিয়া এম ফারুকী নামের ওই বিচারক ফেসবুকের আপত্তির জবাবে তার পরবর্তী চিঠিতে জানিয়েছেন, কেবলমাত্র যেসব কন্টেন্ট মুছে ফেলা হয়েছে, সেগুলোই জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, ফলে আইন লঙ্ঘনের কোনো সুযোগ নেই।

পাশাপাশি, এক্ষেত্রে ফেসবুক আইনি বাধ্যবাধকতা ও গ্রাহকের নিরাপত্তার বিষয়টিকে অজুহাত হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে অভিযোগ করে জিয়া এম ফারুকী বলেন, ‘ফেসবুকের যে ব্যাক্তিগত সুরক্ষা নীতিমালা রয়েছে, তা বিভ্রান্তিতে পরিপূর্ণ; এবং এই ত্রুটিপূর্ণ গোপনীয়তা/ ব্যক্তিগত সুরক্ষা নীতিমালা ফেসবুক বহাল রাখতে পেরেছে সংবাদমাধ্যমগুলোর আন্তরিক সহযোগিতার মাধ্যমে।’

বিচারকের এই জবাবের পর ফেসবুক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল বার্তাসংস্থা রয়টার্স। কোম্পানিটির এক মুখপাত্র এ বিষয়ক এক প্রশ্নের উত্তরে রয়টার্সকে বলেন, আদালতের চিঠি পাওয়ার পর  ফেসবুক কর্তৃপক্ষ তাদের সিদ্ধান্ত পুনঃবিবেচনা করছে। পাশাপাশি তিনি ‍আরও জানান, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়ে জাতিসংঘের যে তদন্ত কার্যক্রম চলছে, তাতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে সহায়তায় করছে ফেসবুক।

২০১৭ সালে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান শুরু করে মিয়ানমার। অভিযানে ব্যাপকমাত্রায় রোহিঙ্গাদের ব্যাপকমাত্রায় গণহত্যা ও ধর্ষণ করে মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।

সেনা সদস্যদের নির্যাতন থেকে প্রাণে বাঁচতে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন দেশ ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে, রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূলের অভিপ্রায় নিয়ে রাখাইনে অভিযান চালিয়েছিল সেনাবাহিনী।

সেনাবাহিনী যখন ,মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছিল, সে সময় দেশটিতে ক্ষমতাসীন ছিল অং সান সুচির নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকার। মিয়ানমারের তৎকালীণ সরকার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগণের মধ্যে তখন এই ব্যাপক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ লক্ষ্য করা যায়নি।

উপরন্তু আন্তর্জাতিক আদালতে এ ঘটনায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাতমাদৌয়ের বিরুদ্ধে যে মামলা চলছে, তাতে সেনাবাহিনীর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন অং সান সুচি, যিনি চলতি বছর সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে গৃহবন্দি অবস্থায় আছেন।

২০১৮ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক তদন্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর ক্ষেত্রে মূল ভূমিকার রেখেছে ফেসবুক।

বার্তাসংস্থা রয়টার্সের অনুসন্ধানে সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের উদ্দেশে ঘৃণামূলক এক হাজার ফেসবুক পোস্ট ও কন্টেন্ট পাওয়া গেছে, যেগুলোতে রোহিঙ্গাদের কুকুর, পোকার ডিম এবং ধর্ষক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

উদ্ধারকৃত সেসব পোস্ট- কন্টেন্টের মধ্যে রোহিঙ্গাদের টুকরো টুকরো করে পশুপাখি দিয়ে খাওয়ানো এবং তাদেরকে হত্যা করা হবে না দেশ থেকে নির্মূল করা হবে- এ জাতীয় বিতর্কও রয়েছে।

তবে রয়টার্সের অনুসন্ধানে যেসব পোস্ট ও কন্টেন্টের তথ্য জানা গেছে, সেগুলো এখনও মুছে ফেলা হয়নি। রোহিঙ্গা নির্যাতনে উস্কানি দিয়ে মিয়ানমারের ফেসবুক ব্যবহারকারীরা যেসব পোস্ট দিয়েছিলেন, তার অধিকাংশই পরে মুছে ফেলা হয়েছে।

বিচারক জিয়া এম ফারুকী তার চিঠিতে উল্লেখ করেছেন, ব্যাক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষার অজুহাতে ফেসবুক এতদিন পর্যন্ত এসব উস্কানিমূলক কন্টেন্ট প্রকাশ না করায় তিনি স্তম্ভিত।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক দূত শ্যানন রাজ সিং এক টুইটবার্তায় যুক্তরাষ্ট্রের জজের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, ‘এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে এই প্রথম বর্তমান যুগের সহিংসতা প্রতিরোধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর ভূমিকার ওপর আলোপকাত করা হয়েছে।’

সূত্র : রয়টার্স

এসএমডব্লিউ