করোনা টিকা নিয়ে ব্রিটেনের বর্ণবাদী আচরণে বিতর্ক
ভারত বা বাংলাদেশে যারা দুই ডোজ কোভিশিল্ড টিকা পেয়েছেন, ব্রিটেন তাদেরকে পূর্ণ টিকাপ্রাপ্ত হিসেবে স্বীকার না করায় নতুন বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। গত শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) ব্রিটিশ সরকার তাদের যে সবশেষ ভ্রমণ নির্দেশিকা জারি করেছে তাতে ইউরোপ, আমেরিকার বাইরে আরও ১৭টি দেশে পূর্ণ টিকাপ্রাপ্তদের ‘ডাবল ভ্যাকসিনেটেড’ হিসেবে স্বীকার করার কথা জানানো হলেও ভারত বা বাংলাদেশ সে তালিকায় ঠাঁই পায়নি।
ভারতে শশী থারুর, জয়রাম রমেশের মতো সিনিয়র কংগ্রেস নেতারা প্রকাশ্যেই অভিযোগ করছেন, যুক্তরাজ্যের এই অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত ‘বর্ণবাদ’ ছাড়া কিছুই নয়। বিষয়টি নিয়ে ভারত কূটনৈতিক স্তরে ব্রিটেনের কাছে প্রতিবাদ জানাচ্ছে বলেও বিবিসি জানতে পেরেছে।
বিজ্ঞাপন
ব্রিটেনের অত্যন্ত জটিল ও বিতর্কিত ‘ট্র্যাফিক লাইট ট্র্যাভেল সিস্টেম’, অর্থাৎ বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাজ্যে আসার ক্ষেত্রে যে সব আলাদা আলাদা নিয়মকানুন মানতে হবে - তা আগামী ৪ অক্টোবর থেকে অনেকটা সহজ করার কথা ঘোষণা করেছে সে দেশের সরকার।
তাতে বলা হয়েছে, ইউরোপ, ব্রিটেন, আমেরিকার বাইরেও আরও অন্তত ১৭টি দেশে যারা অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ফাইজার, মডার্না বা জনসন অ্যান্ড জনসনের পূর্ণ ডোজ টিকা পেয়েছেন তাদেরও সম্পূর্ণ টিকাপ্রাপ্ত হিসেবে গণ্য করা হবে এবং ব্রিটেনে নামার পর তাদের আর কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে থাকতে হবে না।
এই ১৭টি দেশের তালিকায় মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার বা তাইওয়ান, অ্যান্টিগার মতো দেশ জায়গা পেলেও ভারত বা বাংলাদেশ কেন নেই - সে প্রশ্ন জোরেশোরে উঠতে শুরু করেছে। ভারতে বেশিরভাগ নাগরিক যে কোভিড টিকা পেয়েছেন সেটি হল কোভিশিল্ড। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত এই টিকা ভারতের পুনের সিরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশেও টিকাপ্রাপ্তদের অধিকাংশই এই কোভিশিল্ড নিয়েছেন, কারণ দেশটিতে প্রথম দিকে টিকার চালানের পুরোটাই গেছে ভারত থেকে। ব্রিটেনের নতুন নিয়মে এই ভারতীয় ও বাংলাদেশি কোভিশিল্ড-প্রাপ্তরা ‘পূর্ণ টিকাপ্রাপ্ত’ হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন না।
‘এতো পরিষ্কার বর্ণবাদ’
এমন কী, অন্য কোনও নির্মাতার টিকা নিলেও ভারত বা বাংলাদেশের টিকাদান কর্মসূচীকেই বস্তুত স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করছে ব্রিটেন। ভারতের সাবেক ক্যাবিনেট মন্ত্রী, কংগ্রেস নেতা ও এমপি জয়রাম রমেশ এদিন সকালেই টুইট করেছেন, ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্ত ‘বর্ণবাদ’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
তিনি বলছেন, ‘পুরো ব্যাপারটাই আসলে চরম অযৌক্তিক। প্রথমত, এই কোভিশিল্ড টিকার ফর্মুলা ব্রিটেনেই তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভারতে তৈরি করার পর সেই টিকা ব্রিটেন-সহ বহু দেশে পাঠানো হয়েছে, ব্রিটেন তাদের অন্তত ৫০ লাখ নাগরিককে ভারতে নির্মিত সেই টিকাও দিয়েছে।’
তার ভাষায়, ‘মেইড-ইন-ইন্ডিয়া কোভিশিল্ড ব্রিটেনে দেওয়া হলে ক্ষতি নেই, অথচ একই জিনিস ভারতে দিলে মানা যাবে না - এটা কী ধরনের যুক্তি?’
রমেশের সতীর্থ ও ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শশী থারুরও লিখেছেন, ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্তের কারণে তিনি সে দেশে নিজের একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না। পূর্ণ টিকাপ্রাপ্ত ভারতীয়দের সে দেশে কোয়ারেন্টাইন করতে বলাকে অত্যন্ত ‘অবমাননাকর’ বলে বর্ণনা করেছেন তিনি।
বিষয়টি যে ভারতের জন্য অস্বস্তিকর, দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও তা একান্তে স্বীকার করছেন। তবে সেই সঙ্গে তারা জানাচ্ছেন, এর আগে আগস্টের শুরুতেও ভারতকে ব্রিটেনের রেড লিস্ট থেকে সরানোর ক্ষেত্রে তাদের কূটনৈতিক তৎপরতা কাজে দিয়েছিল - এবারেও তারা ব্রিটিশ সরকারকে বুঝিয়ে রাজি করাতে পারবেন বলেই আশা করা হচ্ছে।
চলতি সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের সঙ্গে আলোচনাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরন্দ্রে মোদি বিষয়টি উত্থাপন করতে পারেন বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
ঘাটতি ছিল ভারতেরও?
তবে কোভিশিল্ডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ভারতের যে কোথাও একটা ঘাটতি ছিল, তা স্বীকার করছেন অনেক বিশেষজ্ঞই। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও নেদারল্যান্ডসে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত ভাস্বতী মুখার্জি বলছেন, ‘এর আগেও ইউরোপের একটি দেশ বলেছিল- আমরাও কোভিশিল্ড দিয়েছি ঠিকই - কিন্তু ভারতে বানানো কোভিশিল্ডের সঙ্গে আমাদের দেওয়া টিকার ১ দশমিক ১২ শতাংশ পার্থক্য আছে।’
তিনি বলছেন, ‘অন্যভাবে বললে, শ্বেতাঙ্গদের জন্য যা ঠিক আছে, বাদামি চামড়ার নারী-পুরুষের জন্য তা ঠিক নেই! কোভিশিল্ড অনুমোদনের ক্ষেত্রেও প্রতিটি দেশ আলাদা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ব্রাসেলসের রেগুলেটর এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি - যেটা হওয়া উচিত ছিল না।’
ভাস্বতী মুখার্জি আর বলছেন, ‘আসলে আমরা এ ব্যাপারে যথেষ্ঠ চাপ বোধ হয় তৈরি করতে পারিনি - অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত কোভিশিল্ড দুনিয়ার সব দেশেই অনুমোদন পাওয়া উচিত ছিল।’
জয়রাম রমেশও বলেছেন, ভারতের টিকাদান কর্মসূচি নিয়ে ব্রিটেনের কোনো সন্দেহের কারণ থাকলে তাদের সেটা পরিষ্কার করা উচিত।
সূত্র: বিবিসি বাংলা
টিএম