যেভাবে নতুন শাসন মানিয়ে নিচ্ছেন আফগানরা
উত্তর আফগানিস্তানের মাজার-ই-শরিফের বলখ এয়ারফিল্ডে নামছে একটি রুশ নির্মিত এমআই-১৭ হেলিকপ্টার। তালেবান যোদ্ধারা বেশ উৎফুল্ল ভঙ্গিতে সেটির ছবি তুলছেন। হেলিকপ্টারটির আরোহীদের মধ্যে আছেন ঊর্ধ্বতন তালেবান কর্মকর্তারা। তবে ককপিটে চালকের আসনে বসে আছেন তাদের সাবেক শত্রু, আফগান বিমান বাহিনীর পাইলট।
মৌলভী আবদুল্লাহ মনসুর হচ্ছেন এই এয়ারফিল্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত তালেবান অধিনায়ক। এয়ারফিল্ডে তার অধীনে এখন যেসব বিমান এবং সামরিক সাজ-সরঞ্জাম, তিনি সেগুলো ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন বিবিসির প্রতিনিধি সেকান্দার কেরমানিকে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাহিনী আফগানিস্তানের সাবেক সরকারকে এগুলো উপহার দিয়েছিল। এর মধ্যে আছে যুদ্ধবিমান, আছে হামলা চালানোর মতো সামরিক হেলিকপ্টার।
বিজ্ঞাপন
আফগানিস্তানের সাবেক সরকারের আমলে এসব বিমান এবং হেলিকপ্টার দিয়েই তালেবানের বিরুদ্ধে হামলা চালানো হতো। কিন্তু এখন যুদ্ধ যেহেতু শেষ, তাই এগুলো এখন কী কাজে ব্যবহৃত হবে, তা স্পষ্ট নয়।
তবে ভবিষ্যতে যদি দরকার হয়, এগুলো আমাদের হাতে আছে, বলছেন আবদুল্লাহ মনসুর। গত আগস্ট মাসের বিজয়ের আগে তালেবান যখন আফগানিস্তানজুড়ে তাদের অগ্রাভিযান অব্যাহত রেখেছিল, তখন আফগান বিমান বাহিনীর কয়েক ডজন পাইলট তাদের প্রাণের ভয়ে বিমান নিয়ে পালিয়েছিলেন। তবে অনেকেই আফগানিস্তানে থেকে যান। এখন তারা তালেবান নেতৃত্বের অধীনেই কাজ করছেন। তাদের ক্ষমা করে দেয়া হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়েছে।
যে শত্রুর বিরুদ্ধে তিনি একসময় লড়াই করেছেন, এখন তার সঙ্গেই কাজ করতে কেমন লাগছে জানতে চাইলে মৌলভী মনসুর বলেন, আমাদের মনে সবসময় এই বিশ্বাস ছিল যে জয় আমাদের হবেই এবং আমরা দেশকে মুক্ত করবো। কিন্তু আমরা এটাও জানতাম যে একদিন সকালে আমাদের এক সঙ্গে বসতে হবে এবং এক সঙ্গে কাজ করতে হবে। কারণ তারাও তো আমাদের দেশেরই মানুষ।
মৌলভী মনসুরের পাশে বসে আছেন হেলিকপ্টার পাইলট গুল রহমান। তিনি বিবিসির প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন বেশ সতর্কতার সঙ্গে। গুল রহমান বলছেন, যখন তিনি তালেবানের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা শুনলেন, তখন আর কাজে ফিরতে তার ভয় করেনি। এটা যে ঘটবে, তা অবশ্যম্ভাবী ছিল।
তিনি বলেন, আমাদের কখনোই মনে হয়নি চিরকাল আমাদের এরকম আলাদা পথে চলতে হবে... আমরা রাজনীতিটা রাজনীতিকদের কাছেই ছেড়ে দিতে চাই এবং আমাদের দেশের উন্নয়নে একসঙ্গে কাজ করতে চাই।
তরুণ তালেবান যোদ্ধারা এয়ারফিল্ডের হ্যাঙ্গারের আশপাশে জটলা করছিলেন। তারা কৌতুহলের সঙ্গে দেখছিলেন দুটি এমডি-৫৩০ হেলিকপ্টার। একজন তালেব যখন এক মেকানিককে তার যোগ্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন করছিল, তখন সেখানে একটা চাপা উত্তেজনা টের পাওয়া গেল।
অভিযোগের সুরে এই তালেব বলেন, তুমি এই চাকুরি পেয়েছো তোমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং যোগাযোগের কারণে, তোমার যোগ্যতার কারণে নয়। তবে এরকম কথাবার্তা সত্ত্বেও সেখানে একটা সৌহার্দের পরিবেশই দেখা যায়।
তবে আফগানিস্তানের পুরোনো শাসনামল থেকে নতুন শাসনামলে উত্তরণের ব্যাপারটি সব জায়গায় এত মসৃণভাবে ঘটছে না। দেশটি এখন অর্থনৈতিক সংকটের মুখে। তাদের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ জব্দ করে রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সিদ্ধান্ত নিচ্ছে কীভাবে তালেবানকে বাদ দিয়ে আফগানদের সাহায্য করা যায়।
আফগানিস্তানে ব্যাংক থেকে নগদ অর্থ উত্তোলনের সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকগুলোর সামনে লম্বা লাইন। দেশের বিভিন্ন শহরে এখন পুরোনো জিনিসপত্রের বাজার গড়ে উঠেছে। সেখানে আফগানরা মরিয়া হয়ে সংসারের পুরোনো জিনিসপত্র বিক্রি করছেন, যাতে অন্তত খাদ্য কেনার টাকা পাওয়া যায়।
শাগুফতা নামের এক নারী রাস্তার ধারে বসে ছিলেন। ঘর থেকে বিক্রির জন্য আনা পুরোনো কাপড়-চোপড় হাতড়াচ্ছিলেন। অশ্রুসজল চোখে তিনি বলেন, এখন বেঁচে থাকাটাই যেন এক ধরনের অপমান, আমরা ধীরে ধীরে মারা যাচ্ছি।
শাগুফতার শরীর বেশ দুর্বল, কারণ সকালে তিনি নাস্তা পর্যন্ত করেননি। আগের রাতেও কোন খাবার জোটেনি। তিনি বলেন, খাবার যা ছিল, তা বাচ্চাদের দিয়েছি। এখন আমি তাদের ভালো কাপড়-চোপড়গুলোও বিক্রি করে দিচ্ছি, কোন বিয়ের অনুষ্ঠানে ওরা যেসব পোশাক পরে যেত... যদি ভালো দাম পাই তাহলে সেই টাকা দিয়ে তেল, চাল এবং আটা কিনবো।
শাগুফতার গল্প আফগানিস্তানে যে গভীর বৈষম্য, সেটাকেই যেন তুলে ধরছে। ছয় বছর আগে তার স্বামী আফগানিস্তানের পুলিশ বাহিনী থেকে অবসরে যায়। কিন্তু বিগত সরকারের আমলে তারা সরকারের কাছ থেকে বলতে গেলে কোন পেনশনই পায়নি। শাগুফতা তার পাড়ায় কাপড় ধোয়া এবং কাপড় সেলাইয়ের কাজ করতেন, সেটা দিয়েই কষ্ট করে তাদের সংসার চলতো। কিন্তু আর্থিক সংকট বাড়তে থাকায় সেই কাজও আর সেরকম পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি বলেন, ইসলামিক আমিরাত ভালো, কারণ এখন চুরি-চামারি বন্ধ, কোনও অপরাধ আর ঘটছে না। কিন্তু আমাদের সমস্যা একটাই। আমাদের কোনও কাজ নেই, আমাদের হাতে কোনও টাকা নেই।
মাজার-ই-শরিফের পুরোনো জিনিসপত্রের বাজার বেশ জমে উঠেছে। এই বাজারের বেশিরভাগই সরকারি কর্মচারি। গত দু’মাস ধরে সরকারি খাতের বেশিরভাগ কর্মচারী কোনও বেতন পাননি।
আফগানিস্তানের সাবেক সরকারের আমলেই সমস্যাটি শুরু হয়েছিল, কিন্তু তাদের কোনও ধারণা নেই— কখন তারা আবার বেতন পাবেন, কিংবা আদৌ পাবেন কি-না।
একজন শিক্ষিকা এরই মধ্যে তার ঘরের যা যা বিক্রি করা সম্ভব, তার সবকিছুই বিক্রি করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি নিজের ঘরেই একজন দোকানদারে পরিণত হয়েছি এবং আমার সব জিনিস বিক্রি করে দিয়েছি... বিক্রি করে যা পেয়েছি তা দিয়ে খাবার কিনছি। আমি যখনই এখানে আসি এবং লোকজনের অবস্থা দেখি, আমি বাড়ি ফিরে গিয়ে কাঁদি।
এই নারী বলছেন, এত কিছুর পরও তিনি প্রতিদিন তার কাজে যাচ্ছেন। বাজার থেকে রাস্তার উল্টো দিকেই মাজার-ই-শরিফের প্রধান হাসপাতাল। এটি এখন পরিচালনা করেন একজন তালেবান কর্মকর্তা। তবে তার ডেপুটি হিসেবে যিনি আছেন, তিনি আগের সরকারের আমল থেকেই ওই পদে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন।
তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত এই হাসপাতালের কর্মীদের বেতন দেয়া হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের খরচ কোথায় থেকে আসবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটেনি। অন্যদিকে ওষুধের যে বর্তমান মজুদ, তা দিয়ে আর বড়জোর এক মাস চলবে।
আফগানিস্তানে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে যে ধরনের সহিংসতা এবং রক্তপাতের আশঙ্কা করা হয়েছিল, শেষ পর্যন্ত তার চেয়ে কমই হয়েছে। কিন্তু দেশটির প্রায় অর্ধেক অংশ জুড়ে এখন তীব্র অভাব। বহু মানুষ এখন বেঁচে থাকার জন্য আগের চেয়েও বেশি কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত।
কাবুলে এক সাবেক পুলিশ সদস্যের দেখা পাওয়া যায়, যিনি কোনও রকমে দিন চালিয়ে নিচ্ছেন। তিনি বলেন, সরকারে কে থাকলো না থাকলো, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। রাস্তার ধারে বসে তিনি এখন তালেবানের পতাকা বিক্রি করেন।
সাবেক এই আফগান পুলিশ সদস্য বলেন, এখানে করার মতো আর কোনও কাজ নেই। কাজেই আমি আর কী করতে পারি? বিবিসি বাংলা।
এসএস