যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার ওপর যে কারণে ক্ষুব্ধ ফ্রান্স
চীনকে মোকাবিলা করতে প্রভাবশালী পশ্চিমা তিনটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার উদ্যোগে অকাস নামের একটি নিরাপত্তা চুক্তির কথা ঘোষণা করার কয়েকদিন পরেই এই সমঝোতা বড় ধরনের সমালোচনার মুখে পড়েছে। ঐতিহাসিক এই চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের পক্ষ থেকে অস্ট্রেলিয়াকে পারমাণবিক সাবমেরিন নির্মাণের জন্য উন্নত প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি সরবরাহের কথা বলা হয়েছে।
পরমাণু শক্তিধর দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের শক্তিধর সদস্য ফ্রান্স এই চুক্তির কঠোর সমালোচনা করেছে। অকাসের তীব্র নিন্দা করে বলেছে- এর মাধ্যমে তাদের ‘পিঠে ছুরি মারা হয়েছে।’
বিজ্ঞাপন
ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে এরকম একটি নিরাপত্তা চুক্তির ব্যাপারে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ প্যারিস এর প্রতিবাদে যুক্তরাষ্ট্র এবং অস্ট্রেলিয়ায় তাদের নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়েছে। পশ্চিমা কোনো মিত্র দেশ থেকে রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পাঠানো খুবই অস্বাভাবিক ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়া থেকে ফ্রান্স তাদের রাষ্ট্রদূতদের এই প্রথমবারের মতো ডেকে পাঠাল।
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, পরিস্থিতির ভয়াবহতার কথা বিবেচনা করেই তাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যঁ ইভ লু দ্রিয়া শুক্রবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাত্রোঁর নির্দেশে রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘এই চুক্তির মাধ্যমে (ফ্রান্সকে) পেছন থেকে ছুরি মারা হয়েছে। যে সমঝোতা হয়েছে তাতে মিত্র দেশ ও অংশীদারদের মধ্যে এমন আচরণের বিষয় রয়েছে যা গ্রহণযোগ্য নয়। আমাদের জোটসমূহের যে লক্ষ্য, অংশীদারিত্বের ওপর এর প্রভাব পড়বে।’
ফরাসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষায়, ‘আমরা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বিশ্বাসের সম্পর্ক স্থাপন করেছিলাম। অস্ট্রেলিয়া সেই বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছে।’
ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের অনেকেও নতুন এই সমঝোতার সমালোচনা করছেন এবং এর নামের উচ্চারণের সাথে মিলিয়ে জোটটিকে ‘অকওয়ার্ড’ বা ‘বেমানান’ বলেও উল্লেখ করেছেন। চীনও এই উদ্যোগের সমালোচনা করে একে ‘স্নায়ু যুদ্ধের মানসিকতা’ বলে উল্লেখ করেছে।
কী আছে অকাস চুক্তিতে
মূলত বিরোধপূর্ণ দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রভাব মোকাবিলার জন্যই নতুন এই অকাস জোট গঠন করা হয়েছে। ওই অঞ্চলে বহু বছর ধরেই সংকট বিরাজ করছে এবং এর জের ধরে উত্তেজনাও চলছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন এবং অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন গত বুধবার অকাস গঠনের কথা ঘোষণা করেন। এই তিন নেতার এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘অকাসের আওতায় প্রথম উদ্যোগ হিসেবে আমরা পরমাণু-চালিত সাবমেরিন সক্ষমতা অর্জনে সহায়তায় অঙ্গীকার করছি। এটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতায় এবং আমাদের যৌথ স্বার্থের সহায়তায় মোতায়েন করা হবে।’
নবগঠিত অকাস জোটের তিনটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছে তাতে পরমাণু শক্তি-চালিত সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজ তৈরির জন্য অস্ট্রেলিয়াকে প্রযুক্তি সরবরাহ করার কথা বলা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণে অ্যাডেলেইডে এসব সাবমেরিন নির্মাণ করা হবে।
অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইন্সটিটিউটের একজন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ মাইকেল শোব্রিজ বলেছেন, ‘একটি পারমাণবিক সাবমেরিনের প্রতিরক্ষা বিষয়ক প্রচণ্ড সক্ষমতা রয়েছে। এর ফলে কোনো অঞ্চলে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়ে। বিশ্বের মাত্র ছ’টি দেশের পারমাণবিক সাবমেরিন রয়েছে।’
অস্ট্রেলিয়ার জন্য সাবমেরিন নির্মাণের পাশাপাশি গোয়েন্দা ও কোয়ান্টাম প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তথ্য ও প্রযুক্তি বিনিময়ের কথা বলা হয়েছে এই চুক্তিতে।
কেন ক্ষুব্ধ ফ্রান্স
যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়ার এই নতুন উদ্যোগে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ হয়েছে প্যারিস। কারণ তারা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই চুক্তির ফলে অস্ট্রেলিয়ার সাথে তাদের পূর্ব-স্বাক্ষরিত বহু কোটি ডলারের একটি সমঝোতার অবসান ঘটেছে।
২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলার মূল্যের সেই চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল, যার আওতায় অস্ট্রেলিয়ার জন্য ১২টি সাবমেরিন নির্মাণ করার কথা ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র বিষয়ক বিবিসির সংবাদদাতা বারবারা প্লেট-আশার বলছেন, অকাস চুক্তিটি ফ্রান্সের জন্য একদিকে অর্থনৈতিক ধাক্কা। তেমনি নতুন এই নিরাপত্তা চুক্তির ঘোষণা ফরাসি নেতাদের জন্য বিস্ময়করও, কারণ এ বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা ছিল না।
নতুন এই জোট গঠনের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ফ্রান্সকে এ বিষয়ে অবহিত করা হয়।
বারবারা প্লেট-আশার বিবিসির ওয়েবসাইটে এই ঘটনার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পাঠানোর ঘটনা সম্ভবত নজিরবিহীন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচীনতম বন্ধু ফ্রান্স। হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারাও একথা উল্লেখ করেছেন।’
ফ্রান্স বলছে, অর্থনৈতিক কারণে তারা ক্ষুব্ধ হয়নি। তাদের ক্ষোভের পেছনে কূটনৈতিক এবং নিরাপত্তা-জনিত কারণও রয়েছে।
প্যারিস থেকে বিবিসির সংবাদদাতা হিউ স্কফিল্ড বলছেন, ‘প্যারিসে এলিজি প্রাসাদ উদ্বিগ্ন এ কারণে যে, ওয়াশিংটন, ক্যানবেরা এবং লন্ডনের কর্মকর্তারা তাদের ক্ষোভের কারণকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করছেন এবং তাদেরকে ছোট করে দেখছেন।’
‘ফ্রান্স বলছে- সাবমেরিন চুক্তির কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে বলে তারা ক্ষুব্ধ হয়নি। বরং মিত্র দেশ হওয়া স্বত্বেও, যেভাবে ফ্রান্সকে এই দৃশ্যের বাইরে রেখে ইংরেজিভাষী তিনটি দেশের মধ্যে গোপনে আলাপ আলোচনা হয়েছে তাতে তারা ক্ষুব্ধ।’
বিবিসির সাংবাদিক হিউ স্কফিল্ড বলেন, ‘এ কারণেই প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ শুক্রবার রাতে তার রাষ্ট্রদূতদের ডেকে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। তারা দেখাতে চাইছে ফ্রান্সের জন্য এটি অনেক বড় একটি বিষয়। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাজ্যের সাথে ফ্রান্সের সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।’
অকাসের তিনটি দেশের প্রত্যেকটির সঙ্গেই ঘনিষ্ঠ সামরিক সম্পর্ক রয়েছে ফ্রান্সের। বিশেষ করে আফ্রিকার সাহের অঞ্চল ও আফগানিস্তানসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে সন্ত্রাসবাদ দমনে তারা এই তিনটি দেশের সঙ্গে কাজ করেছে।
টিএম