কাবুল দখলে নেওয়ার পর তালেবান তাদের আগের শাসনামলের চেয়ে তুলনামূলক কম চরমপন্থা অবলম্বনের ইঙ্গিত দিয়েছিল। কিন্তু গত কয়েকদিনের ঘটনায় তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে এই মুহূর্তে আফগানিস্তানে কোন সরকার নেই। নতুন সরকারের গঠন নিয়ে এরই মধ্যে আলোচনা শুরু করেছে গনি সরকারকে হটিয়ে কাবুলের দখল নেয়া তালেবান। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নতুন সরকারের কাঠামো চূড়ান্ত হবে বলে জানানো হয়েছে।

সরকার না থাকলেও কাবুল ও আফগানিস্তান কার্যত তালেবানরাই নিয়ন্ত্রণ করছে। আগের সরকার বা বিদেশিদের সঙ্গে কাজ করাদের ওপর বিভিন্ন জায়গায় হামলার খবর পাওয়া যাচ্ছে। সাংবাদিকদের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি, না পেয়ে পরিবারের সদস্যকে হত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। হাজারা, শিয়াসহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এসব ঘটনার কথা উড়িয়ে দিচ্ছে না তালেবানরাও। তাদের এক নেতা বার্তা সংস্থা রয়টার্সের কাছে স্বীকার করে বলেছেন, ‘আমরা নাগরিকদের ওপর নিষ্ঠুরতা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালানোর কিছু ঘটনা জানতে পেরেছি। যদি তালেবানের কোনও সদস্য এমন আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা করে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা আতঙ্ক, চাপ ও উদ্বেগের বিষয়টি বুঝতে পারছি। মানুষ মনে করছে আমরা দায়িত্বশীল হব না, কিন্তু বিষয়টি তেমন নয়।’

দেশ ছাড়ছেন আতঙ্কিত মানুষ

প্রস্তাবিত নতুন কাঠামোর মধ্যে প্রত্যেকের অধিকার রক্ষা করা হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন তালেবান নেতারা। তবে ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের নিষ্ঠুর আচরণের কারণে এ বিষয়ে সবাই আশ্বস্ত হতে পারছেন না। নারী-পুরুষ সম্পর্কের জন্য পাথর নিক্ষেপ, চুরির জন্য হাত কেটে ফেলা, মেয়েদের শরীর দেখা যাওয়ায় লাঠিপেটার মতো ঘটনা সেসময় সাধারণ হয়ে গিয়েছিল।

এ কারণে তালেবানরা পুরোপুরি সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার আগেই আফগানিস্তান ছাড়তে চাইছেন অনেকে। তাদের ভয়, গত ২০ বছরে টেলিযোগাযোগ, গণমাধ্যম, চলাফেরার স্বাধীনতা, নারী ও মেয়েদের অধিকারসহ যেসব সুযোগ তৈরি হয়েছিল এবং যেভাবে জীবন-যাপন করছিলেন তা আবারও এ মৌলবাদী গোষ্ঠী ধ্বংস করে দেবে।

এমন বাস্তবতায় কয়েক হাজার মানুষ প্রতিদিন দেশ ছাড়তে কাবুল বিমানবন্দরে প্রবেশের চেষ্টা করছেন। রোববার বিমানবন্দর এলাকায় সাতজন মারা গেছেন। মানুষকে শৃঙ্খলায় আনতে তালেবান সদস্যরা ফাঁকা গুলি ছোড়ার পাশাপাশি লাঠিচার্জ করেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে রয়টার্স জানিয়েছে। ন্যাটোর হিসাবে, কাবুল বিমানবন্দর ও এর আশেপাশে গত সাতদিনে মোট ২০ জন মারা গেছেন।

যারা দেশ ছাড়তে চাইছেন তাদের সমালোচনা করে শুক্রবার জুমার নামাজের সময় তালেবান সমর্থক এক ইমাম মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যাদের হৃদয় দুর্বল তারাই আমেরিকার বিমানের পেছনে দৌড়াচ্ছে।’ তিনি সবাইকে দেশে অবস্থান ও দেশ গড়ায় অংশ নেয়ারও পরামর্শ দেন।

এর আগে তালেবানের পক্ষ থেকেও মুসল্লিদের প্রতি এমন বক্তব্য দিতে ইমামদের আহ্বান জানানো হয়েছিল। তালেবানের এক মুখপাত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, যারা বিমানবন্দরে ছুটে যাচ্ছে তাদেরকে বাধা দেয়া হতে পারে। তিনি বলেন, ‘স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় পশ্চিমাদের আরো ভালো পরিকল্পনা থাকা উচিত ছিল।’

প্রতিশ্রুতির পরও প্রতিশোধমূলক আচরণ বন্ধ হয়নি

তালেবানরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে, তারা কারো সঙ্গে কোনও প্রতিশোধমূলক আচরণ করবে না। তবে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা বলছে, গত কয়েকদিনে তালেবান শাসনের বিরোধী এবং বিগত সরকার ও বিদেশিদের সঙ্গে কাজ করাদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।

ডয়চে ভেলের একজন আফগান সম্পাদক জানিয়েছেন, তালেবানরা তার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে তাকে না পেয়ে পরিবারের এক সদস্যকে হত্যা করেছে।

জাতিসংঘের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তালেবানরা সাবেক সরকারি কর্মকর্তা, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে কাজ করা আফগানদের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি চালাচ্ছে।

মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে প্রত্যাক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গত জুলাইয়ে ৯ জন হাজারা নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। তাদের মধ্যে ছয়জনকে গুলি ও তিনজনকে নির্যাতন করে মেরে ফেলে তালেবান।

অ্যামনেস্টি বলছে, এমন আরও অনেক ঘটনা ঘটতে পারে যার খবরই পাওয়া যাচ্ছে না। কেননা তালেবান বিভিন্ন জায়গা দখলের পর সেখানকার মোবাইল সেবা বন্ধ করে দিয়েছে; যাতে মানুষ বাইরে যোগাযোগ করতে না পারে এবং কী ঘটছে তা সম্পর্কে গোটা পৃথিবী অন্ধকারে থাকে। ডি ডব্লিউ।

এসএস