ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছেন যে, ‘দেশভাগের বিভীষিকাকে’ মনে করিয়ে দিতে ১৪ আগস্ট দিনটি ‘পার্টিশান হররস্ রিমেমব্রান্স ডে’ হিসাবে পালন করা হবে। টুইটারে তিনি লিখেছেন, দেশভাগের যন্ত্রণার স্মৃতি কখনও ভোলার নয়। সহিংসতার কারণে বহু মানুষ ছিন্নমূল হয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন।

সামাজিক বিভাজন, হানাহানির যে স্মৃতি দেশের মানুষের মনে গেঁথে গেছে, তা থেকে দেশকে মুক্ত করতেই এই বিশেষ দিবসের ঘোষণা বলে তিনি জানিয়েছেন।

দেশভাগের বিভীষিকা কেন মনে করিয়ে দিতে চাইছে বিজেপি?
রোববার ভারতের ৭৫তম স্বাধীনতা দিবস। তার ঠিক আগে ৭৫ বছরের পুরনো দেশভাগের বিভীষিকা কেন মনে করিয়ে দিতে চাইছে বিজেপি? পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উদ্বাস্তু সেলের নেতা মোহিত রায় বলছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে দেশভাগের যন্ত্রনার ইতিহাসে প্রলেপ লাগিয়ে রাখা হয়েছিল, এখন সময় এসেছে ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেওয়ার।

‘আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, আমরা একটা ভারত চেয়েছিলাম যেখানে সবাই এক সঙ্গে থাকবে, কিন্তু একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের অনমনীয় ভাব এবং যে ধরনের সহিংস ভূমিকা নিয়েছিল যার জন্য দুই সম্প্রদায়ের মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেটিকেই মনে করিয়ে দেওয়া।’

তার দাবি, ‘যে ধরনের অন্যায় অবিচার সামগ্রিকভাবে হিন্দু সম্প্রদায় শুধু নয়, হিন্দু সংস্কৃতির ওপরে আক্রমণ করা হয়েছে, সেই ইতিহাস অবশ্যই মনে করিয়ে দিতে হবে।’

দেশভাগের সময়ে মুসলিম লীগ এবং মুসলমান সম্প্রদায়ের অনমনীয় মনোভাব এবং সহিংস হয়ে ওঠার কথাই তিনি বোঝাতে চাইছিলেন সেই ইঙ্গিত মোহিত রায়ের কথায় স্পষ্ট।

দেশভাগের সময়ে শুধুই কি হিন্দুরা আক্রান্ত হয়েছিলেন?
কিন্তু দেশভাগের সময়ে শুধু যে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপরে হামলা হয়েছে তা নয়, ইতিহাস বলছে মুসলমানদের ওপরেও আক্রমণ হয়েছে। দেশভাগের আগে ঢাকায় বসবাস করতেন এমন একটি পরিবারের সদস্য অঞ্জলি সরকার বিবিসিকে বলেছিলেন, তার চোখে দেখা একটি ঘটনার কথা।

স্মৃতি হাতড়ে অঞ্জলি সরকার জানিয়েছিলেন, ‘ঢাকা শহরে আমরা যেখানে থাকতাম, সেটা পুরোটাই হিন্দু পাড়া। একটি শুধু মুসলমান বাড়ি ছিল, তারাও খুবই নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। একদিন দেখলাম আমারই এক মামা তার বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে কেরোসিন ঢেলে ওদের বাড়িটা জ্বালিয়ে দিল।’

দেশভাগের যন্ত্রণা যাদের সবথেকে বেশি ভোগ করতে হয়েছিল, যাদের পিতৃপুরুষের ভিটে ছেড়ে অন্য দেশে চলে আসতে হয়েছিল, সেই উদ্বাস্তুদের প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বারে বারেই লক্ষ্য করেছি ফেলে আসা দেশের কথা হয়তো তারা ভাবেন, কিন্তু ওই বিভীষিকার কথা, দেশ ছেড়ে চলে এসে উদ্বাস্তু শিবিরে থাকার লড়াই এখন আর তারা মনে করতে চান না।

স্মৃতি স্মরণ না কি মুসলিম বিদ্বেষ ছড়ানো?
বাঙালি উদ্বাস্তুদের জয়েন্ট অ্যাকশান কমিটির সর্বভারতীয় সভাপতি সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস বলছিলেন, ‘উচ্চ বর্ণের হিন্দু নেতৃত্ব আর মুসলমান নেতৃত্ব যে একমত হতে পারেননি, যার ফলশ্রুতি দেশভাগ - এ তো সবারই জানা আছে। আবার উদ্বাস্তু সমস্যার সমাধান এখনও পুরোপুরি হয়নি এটা ঘটনা - বিশেষ করে বাঙালি উদ্বাস্তুদের। কিন্তু সেটাকে ধরে বসে থাকলে তো হবে না।’

তিনি বলছেন, ‘নরেন্দ্র মোদি ওই ঘটনার স্মৃতি আবারও উসকিয়ে দিয়ে তার রাজনৈতিক স্বার্থে এটাকে ব্যবহার করার জন্য চেষ্টা করছেন। মুসলিম বিদ্বেষটাকেই ছড়ানোর জন্য তিনি এই উদ্যোগ নিয়েছেন বলে আমার ধারণা।’

‘কোন বিভীষিকা মনে করানোর কথা বলা হচ্ছে’?
দেশভাগ এবং উদ্বাস্তুদের নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করেন নাজেস আফরোজ। তার প্রশ্ন, ‘কোন বিভীষিকা মনে করানোর কথা বলা হচ্ছে? শুধু কি পাকিস্তানের অংশে যা হয়েছিল, সেগুলো, নাকি ভারতেও যা হয়েছিল, সেগুলোও স্মরণ করা হবে?’

তিনি বলছেন, ‘আমার গবেষণার কাজে যখন বাংলাদেশে গিয়েছিলাম, সেখানে খালেদ হোসেইন নামে এক আইনজীবীকে পাই, তাদের আদি বাড়ি ছিল বিহারের পাটনায়। ৪৭ সালে তার বাবার বয়স ছিল ১০-১১ বছর। তার বাবা আমাদের বলেছিলেন যে, তাদের পরিবারের পুরুষদের হত্যা করা হয়েছিল এবং মহিলারা নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে কুয়োয় ঝাঁপ দিয়েছিলেন। তারা দুই ভাই এক চাচার সঙ্গে কোনোমতে পালিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে পৌঁছান।’

‘শুধু একদিকের বিভীষিকাই স্মরণ করা হবে না ভারতে যা যা ঘটেছিল, সেগুলোও স্মরণ করা হবে - এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠবে এবং প্রশ্নটা সরকারের সামনে রাখা দরকার।’

ঘটনাচক্রে দেশভাগের ঠিক আগে ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে কলকাতায় হওয়া গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংস নামে ইতিহাসে পরিচিত দাঙ্গার কথাও সম্প্রতি সামনে এনেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো। আরএসএস যদিও উদ্যোগটা নিয়েছে, কিন্তু দাঙ্গার স্মৃতি ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায় সামনে রাখা হচ্ছে রামকৃষ্ণ মিশন, ভারত সেবাশ্রম সংঘের মতো কিছু অরাজনৈতিক সংগঠনের সন্ন্যাসীদের।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

টিএম