করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ধরন ডেল্টার প্রভাবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো মালয়েশিয়াতেও প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছে আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে মালয়েশিয়ায় বসবাসকারী সব প্রাপ্তবয়স্ককে করোনা টিকার ডোজ নেওয়া বাধ্যতামূলক করেছে দেশটির সরকার।

সেই অনুযায়ী, দেশটির সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক টিকার ডোজও নিচ্ছেন, কিন্তু চলমান এই কর্মসূচির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশটিতে বসবাসরত অবৈধ অভিবাসী ও মিয়ানমার থেকে পালিয়ে মালয়েশিয়ায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা।

অবৈধ অভিবাসী ও রোহিঙ্গা ইস্যুতে মালয়েশিয়ার ক্ষমতাসীন সরকারের কঠোর অবস্থান ও গ্রেফতার এড়াতে কারণে টিকার ডোজ নিতে টিকাকেন্দ্রে তো বটেই, টিকার জন্য নিবন্ধনও (রেজিস্ট্রেশন) করছেন না অনেক রোহিঙ্গা ও অবৈধ অভিবাসী । কারণ, রেজিস্ট্রেশন করতে গেলেই সেখানে নিজের বিষয়ে তথ্য দিতে হবে।

এমনকি, অনেক বৈধ শরণার্থীরও অভিযোগ- টিকার ডোজ নেওয়ার জন্য টিকাকেন্দ্রে গেলে মালয়েশিয়ার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নানাভাবে হয়রানি করছে।

মালয়েশিয়ার অভিবাসী কর্মীদের যাবতীয় বিষয় তত্ত্বাবাধান করে দেশটির মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে বর্তমানে বৈধ অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজার। তবে অভিবাসী ইস্যু নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক এনজিও আইওএমের (ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন) তথ্য অনুযায়ী দেশটিতে বর্তমানে অবৈধ অভিবাসীদের সংখ্যা প্রায় ২০ এবং এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ রোহিঙ্গা।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর (ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশন ফর রেফিউজিস)-এর বরাত দিয়ে আইওএম জানিয়েছে বর্তমানে দেশটিতে অন্তত ২ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা আছে, যারা ইউএনএইচসিআরের নিবন্ধিত শরণার্থী।

জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি মালয়েশিয়া। ইউএনএইচসিআরের নিবন্ধিত নাগরিকদেরও সেখানে অবৈধ অভিবাসী হিসেবে গণ্য ও ধরপাকড় করা হয়। হয়রানি থেকে বাঁচতে অনেক অভিবাসী মালয়েশিয়ার মানব সম্পদ মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন।

কিন্তু এটি একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং আবেদনের পর নিবন্ধিত হওয়ার আগ পর্যন্ত যে কোনো সময় গ্রেফতার ও কারা অন্তরীণ হওয়ার ঝুঁকি থাকে তাদের। এ কারণে স্বাভাবিকভাবেই টিকার ডোজ নেওয়ার জন্য নিবন্ধন করতে ভয় পাচ্ছেন তারা।

মোহাম্মদ জুবায়ের (ছদ্মনাম) নামে এক রোহিঙ্গা শরণার্থী সম্প্রতি নিবন্ধিত শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, করোনা টিকার একটি ডোজও গ্রহণ করেছেন। কিন্তু নিজের স্ত্রীকে টিকার ডোজ দেওয়ার জন্য তাকে নিয়ে টিকাকেন্দ্রে যেতে পারছেন না, কারণ তার স্ত্রী এখনও বৈধ শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পাননি।

একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করা জুবায়ের কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেন, ‘আমি যদি টিকার ডোজ নেওয়ার জন্য তাকে নিয়ে টিকাদান কেন্দ্রের দিকে রওনা হই, তাহলে মাঝপথে পুলিশ আটকাতে পারে এবং আমাদের দু’জনকেই গ্রেফতার করতে পারে।’

‘যদি সরকার নিশ্চয়তা দেয় যে, অনিবন্ধিত শরণার্থীদের টিকাদান কেন্দ্রে যেতে গ্রেফতার হওয়ার কোনো ঝুঁকি নেই, একমাত্র সেক্ষেত্রেই আমি তাকে টিকার ডোজ নেওয়ার জন্য নিয়ে যেতে পারি।’

মালয়েশিয়ার রোহিঙ্গাবিরোধী অবস্থান

গত কয়েক বছর ধরেই অবৈধ অভিবাসী ও বিশেষ করে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করছে মালয়েশিয়ার সরকার ও স্থানীয় জনগণ। মহামারি এই অবস্থানকে আরও তীব্র করেছে।

২০২০ সালের প্রথম দিকে রোহিঙ্গা শরণার্থবাহী নৌযানগুলোকে বন্দরে ভিড়তে দেয়নি মালয়েশিয়ার সরকার। সেই নৌযানসমূহের যাত্রীরা অবৈধ প্রবেশের দায়ে এখনও কারাগারে বন্দি আছেন।

একই বছর এপ্রিলে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেন, বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মালয়েশিয়ায় কোনো মর্যাদা ও অধিকার ভোগ করতে পারবে না। এর দুই মাস পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিন বলেন মালয়েশিয়া আর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চাপ সহ্য করার মতো অবস্থায় নেই।

চলতি বছর এপ্রিল থেকে মালয়েশিয়ায় রোহিঙ্গা বিরোধী অভিযান শুরু করে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেই অভিযানে আটক করা হয় তিন হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গাকে, বর্তমানে তারা কারা অন্তরীণ আছেন।

ওই মাসেই স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগের প্রেক্ষিতে পেনাং রাজ্যের একটি রোহিঙ্গা শিবিরে অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা শিবিরগুলোকে কড়া নজরদারিতে রাখার নির্দেশ দেন। এ সম্পর্কে এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে তিনি বলেছিলেন, ‘জনগণের নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিতের জন্যই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।’

এদিকে, কাছাকাছি সময়ে মালয়েশিয়ার মানব সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অভিবাসী বিভাগ তাদের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে একটি পোস্টার শেয়ার করে। সেই পোস্টারে লেখা ছিল- ‘নৃতাত্ত্বিক রোহিঙ্গা অভিবাসীরা, তোমাদের আগমনকে আমরা আর স্বাগত জানাচ্ছি না।’

রোহিঙ্গা শরণার্থীবাহী নৌযান মালয়েশিয়ার বন্দরে প্রবেশের চেষ্টা করছে এবাং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সশস্ত্র অবস্থায় তাদের ঠেকানোর চেষ্টা করছে- এমন একটি চিত্রও ছিল সেই পোস্টারে। আন্তর্জাতিক সমালোচনার জেরে সেই পোস্টার অবশেষে সরিয়ে ফেলে অভিবাসী বিভাগ।

ভয় ও অবিশ্বাস

মালয়েশিয়ায় গণটিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে চলতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে। মার্চ মাসে প্রথমবারের মতো অভিবাসীদের টিকার ডোজ নেওয়ার আহ্বান জানায় দেশটির সরকার। মালয়েশিয়ার বিজ্ঞান বিষয়ক মন্ত্রী ও চলমান গণটিকাদান কর্মসূচির প্রধান খায়রি জামালউদ্দিন ১৭ ফেব্রয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, অনিবন্ধিত অভিবাসীদেরও টিকা দেওয়া হবে এবং এক্ষেত্রে কোনো হয়রানি করা হবে না।

কিন্তু তার পরের মাস থেকেই দেশজুড়ে রোহিঙ্গা বিরোধী অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জুন মাস পর্যন্ত চলে সেই অভিযান। অভিযান চলাকালে টিকা নিতে যাওয়া অভিবাসীদেরও গ্রেফতার করেছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তখন বলেছিলেন, মালয়েশিয়ার নাগরিকদের রক্ষা করতেই এই অভিযান চালানো হচ্ছে।

দেশে সংক্রমণ লাগামহীন ভাবে বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে ফের অভিবাসীদের টিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে মালয়েশিয়ার সরকার। মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম বেরনামায় বলা হয়েছে, এক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার সরকার কাউকে হয়রানি করবে না এবং অনিবন্ধিত অভিবাসীদের টিকার আওতায় আনা দেশের করোনা মহামারি নির্মূল পরিকল্পনার অংশ।

কিন্তু পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে ‘শিক্ষা নেওয়া’ রোহিঙ্গাদের শঙ্কা এখনও কাটেনি। ফলে সরকারি ঘোষণা সত্ত্বেও ভয় কাটছেনা তাদের।

চিকিৎসকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারর্স (এমএসএফ) এর মালয়েশিয়া শাখা প্রধান ডির্ক ভ্যান ডার টাক এ বিষয়ে আল জাজিরাকে জানান, মালয়েশিয়ার অনিবন্ধিত অভিবাসীদের মধ্যে ভয় ও অবিশ্বাস কাজ করছে।

আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘গণটিকাদান কর্মসূচি সফল করতে হলে মালয়েশিয়ার সরকারকে অবশ্যই অনিবন্ধিত অধীবাসীদের ভয় ও অবিশ্বাস দূর করতে হবে। যদি তাদের টিকার আওতায় আনা না যায়, তাহলে বর্তমান সংক্রমণ পরিস্থিতি আরও দীর্ঘায়িত ও ভয়াবহ রূপ নেবে।’

সূত্র : আল জাজিরা

এসএমডব্লিউ