শেখ জারাহর ফিলিস্তিনিরা: উচ্ছেদের ঝুঁকি মাথায় নিয়ে আর কতদিন?
পূর্ব জেরুজালেমের শেখ জারাহ এলাকায় উচ্ছেদের সম্মুখীন হওয়া ফিলিস্তিনি বাসিন্দাদের নিয়ে একটি অতি স্পর্শকাতর মামলায় কোনো স্পষ্ট রায় দেয়নি ইসরায়েলের সর্বোচ্চ আদালত। এ উচ্ছেদের ঘটনাকে নিয়ে তৈরি হওয়া উত্তেজনার কারণেই গত মে মাসে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে ১১ দিনব্যাপী রক্তাক্ত যুদ্ধ হয়েছিল। ফলে এ মামলাটি আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
ইসরায়েলি সুপ্রিম কোর্ট দীর্ঘ এই আইনি লড়াইয়ের সমাপ্তি ঘটাতে একটি রুলিং দেবে বলে কথা ছিল। তা না করে আদালত উভয় পক্ষকে আপোস-রফা করার আহ্বান জানিয়েছে। তারা প্রস্তাব দিয়েছে, চারটি ফিলিস্তিনি পরিবার শেখ জারাহতে তাদের বাড়িতে তখনই থাকতে পারবে যদি তারা এটা স্বীকার করে যে একটি ইসরায়েলি কোম্পানি ওই জমির মালিক ছিল।
বিজ্ঞাপন
আদালতের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ৭০টিরও বেশি ফিলিস্তিনি পরিবারের ‘সংরক্ষিত ভাড়াটে’র মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকবে এবং তারা যদি ভাড়া দেওয়া অব্যাহত রাখে- তাহলে তাদের উচ্ছেদ করা যাবে না। ফিলিস্তিনি পরিবারগুলো এ ধরনের কোনো সমাধান আগেও প্রত্যাখ্যান করেছিল।
সুপ্রিম কোর্ট শেখ জারাহর বাসিন্দা ফিলিস্তিনিদের একটি তালিকা সাতদিনের মধ্যে দিতে বলেছে- যার অর্থ, চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অন্তত সাতদিন পিছিয়ে দেওয়া হলো।
শেখ জারাহর এই সংঘাতের মূলে কী?
ইসরায়েল অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেমের একটি অঞ্চল হচ্ছে শেখ জারাহ। জেরুজালেম শহরের প্রাচীন অংশ এবং পবিত্র স্থানগুলোর কাছাকাছিই এই এলাকাটির অবস্থান। এই এলাকাটির জমির মালিক কে- এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিবাদ চলছে।
এখানে বসবাসরত ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার জন্য ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারী গোষ্ঠীগুলো দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে চেষ্টা করে চলেছে। এই ফিলিস্তিনিরা এখানে বসবাস করছে দশকের পর দশক ধরে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিনি সংঘাতের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে পূর্ব জেরুজালেম ও তার এই ছোট্ট পাড়াটির অবস্থান।
ইসরায়েল মনে করে পুরো জেরুজালেম শহরটিই তাদের রাজধানী। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অধিকাংশই এ ধারণাকে স্বীকৃতি দেয় না। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা চান, ভবিষ্যতের ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী হবে এই পূর্ব জেরুজালেম।
শেখ জারাহতে কী ঘটছিল?
শেখ জারাহতে শিমন হাৎজাদিকের সমাধির ওপর যে স্মৃতিসৌধ আছে তা ইহুদিদের কাছে পবিত্র স্থান। এর কাছে ইহুদি সমিতিগুলো ১৮৭৬ সালে জমি কিনেছিল এবং ইহুদিদের একটি সম্প্রদায় সেখানে বাস করতো।
কিন্তু ১৯৪৮-৪৯ সালের আরব-ইসরায়েলি যুদ্ধের পর জেরুজালেম দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়, যদিও সেখানে বহুকাল ধরে আরব ও ইহুদিরা পাশাপাশি বাস করতো। তবে ওই যুদ্ধের পর জেরুজালেম শহরের দুই অংশ ইসরায়েল রাষ্ট্র ও জর্ডানের মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
এর ফলে জেরুজালেমের পশ্চিম অংশের ফিলিস্তিনিরা বাস্তুচ্যুত হয়, আর পূর্ব প্রান্ত থেকে ঘরবাড়ি হারাায় ইহুদিরা। জেরুজালেমের পূর্ব অংশ নিয়ন্ত্রণ করতো জর্ডান। ফলে যে ফিলিস্তিনিরা উদ্বাস্তু হয়ে পূ্র্ব জেরুসালেমে চলে গিয়েছিলেন- তাদের দায়িত্ব নেয় জর্ডানের কর্তৃপক্ষ।
জর্ডান এই শরণার্থীদের জন্য ২৮টি বাড়ি তৈরি করে এই শেখ জারাহ এলাকায়। এই জমিটি আগে ছিল ইহুদিদের সমিতির দখলে- যা পরে শত্রু সম্পত্তির রক্ষক জর্ডানিয়ান কর্তৃপক্ষের হাতে চলে যায়। এ জমিগুলোতে বসতি স্থাপন করা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে আশ্বাস দেওয়া হয়, তাদের এ জমির আইনি মালিকানা দেওয়া হবে। কিন্তু তা কখনোই হয়নি।
জাতিসংঘের এক বিশেষ রিপোর্টে বলা হয়, জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংক্রান্ত সংস্থা প্রথমে যে পরিবারগুলোকে এই শেখ জারাহতে থাকার জন্য বেছে নিয়েছিল- তারা তিন প্রজন্ম পরে এখন ৬০টি ফিলিস্তিনি পরিবারে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পরে ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয় এবং সেখানে তাদের নিজেদের আইন কার্যকর করে। জাতিসংঘ তাদের এ কর্মকাণ্ডকে অবৈধ বলে ঘোষণা করেছে। তিন বছর পর, ১৯৭০ সালে একটি আইন করা হয়- যার লক্ষ্য ছিল শেখ জারাহর মতো যেসব এলাকায় জমির মালিকানা নিয়ে পরস্পরবিরোধী দাবি রয়েছে- সেগুলোর নিষ্পত্তি করা।
যেসব জমি ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত জর্ডানের কর্তৃপক্ষ ‘শত্রু সম্পত্তি’ বলে শ্রেণীভুক্ত করেছিল- তা এবার তুলে দেওয়া হয় ইসরায়েলি কাস্টোডিয়ান কাউন্সিল নামে একটি কর্তৃপক্ষের হাতে। তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়, ১৯৪৮ সালে এসব ভূমির মূল মালিক যারা ছিল- তাদের বা তাদের উত্তরাধিকারীদেরকে এসব জমি ফিরিয়ে দেওয়ার।
হারানো জমি ফেরত পাননি ফিলিস্তিনিরা
কিন্তু এখানে লক্ষ্য করার বিষয় যে, হারানো জমি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে ফিলিস্তিনিরা সমান ক্ষমতা পায়নি। পশ্চিম জেরুজালেমে বা ইসরায়েলের অন্য যে কোনো জায়গায় যেসব ফিলিস্তিনিরা জমি-বাড়ি হারিয়েছিলেন, সেসবকে ১৯৫০ সালের একটি আইনবলে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয় এবং নিয়ে নেওয়া হয় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে। ফিলিস্তিনিদের অবশ্য ক্ষতিপূরণ দাবি করার সুযোগ দেওয়া হয়।
শেখ জারাহর যে জমিতে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য বাড়ি তৈরি করা হয়েছিল- সেই জমির দখল দিয়ে দেওয়া হয় দু’টি ইসরায়েলি সমিতিকে। তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে হাজির করেছিল অটোমান-শাসনামলের দলিলপত্র।
এই সমিতিগুলো পরে তাদের জমি বিক্রি করে দেয় নাহালাত শিমন নামে একটি বসতি-স্থাপনকারীদের সংগঠনকে। এই গ্রুপটিই এখন ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদের মামলায় সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। তারা চাইছে, পূর্ব জেরুজালেমের ফিলিস্তিনি-প্রধান এলাকাগুলোতে ইহুদিদের উপস্থিতি বাড়াতে।
টিএম