এই মাইক্রোস্ট্রাকচার থেকেই আদিম স্পঞ্জের অস্তিত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

কানাডার উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের প্রাচীন শিলায় প্রাণীজগতের ফিলাম পর্বভুক্ত প্রাণী সামুদ্রিক স্পঞ্জের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবাশ্মের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। ৮৯ কোটি বছরের প্রাচীন এই জীবাশ্ম বিশ্বের প্রাচীনতম জীবাশ্ম হতে পারে।     

পৃথিবীতে সরল, এক-কোষী জীবনের আবির্ভাব হয় আজ থেকে ৩৪০ কোটি বছর আগে। কিন্তু জটিল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রাণের আবির্ভাব হয় আরও পরে। এখনও পর্যন্ত ধারণা করা হয় আজ থেকে ৫৪ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে প্রথম জটিল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রাণের আবির্ভাব হয়, এটিকে দ্য ক্যামব্রিয়ান এক্সপ্লোশন বলা হয়। কাকতালীয়ভাবে সবচেয়ে প্রাচীন যে স্পঞ্জের জীবাশ্ম পাওয়া যায়, বা যেটিকে নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে দ্বিমত নেই সেটিও প্রায় ৫৪ কোটি বছরের প্রাচীন। 

২০১৮ সালে ৬৬ কোটি থেকে সাড়ে ৬৩ কোটি বছরের পুরোনো শিলায় বেশ পরিচিত বায়োমার্কার স্টেরয়েডের অস্তিত্বের খোঁজ মেলে। স্টেরয়েড হলো প্রাণীদেহে স্বাভাবিকভাবে উত্পন্ন একজাতীয় জৈব যৌগ। এ আবিষ্কারের মাধ্যমে ধারণা জন্মে স্পঞ্জের আবির্ভাব হয়েছিল ক্যামব্রিয়ানেরও অন্তত ১০ কোটি বছর আগে, যে সময়টাকে নিউপ্রোটেরোজোইক যুগ বলা হয়। আধুনিক স্পঞ্জের জেনেটিক বিশ্লেষণ ইঙ্গিত দেয়, পৃথিবীতে সামুদ্রিক এই প্রাণির আবির্ভাব হয়েছে আরও আগে। ফলে পৃথিবীতে প্রাণীগুলোর মধ্যে স্পঞ্জের আবির্ভাবই সবার আগে হয়েছে বলে যে মতবাদ রয়েছে, সেটিই আরও শক্ত হয়। 

সুইডেনের আপসালা ইউনিভার্সিটির জীববিজ্ঞানী প্যাকো ক্যারডিনাস বলছেন, ‘জীবাশ্মের সময়কাল এবং রাসায়নিক ও ডিএনএ’র মধ্যে যে পার্থক্য রয়েছে তা নিয়ে গত কয়েকবছর বহু আলোচনা হয়েছে।’ সুতরাং নতুন যে আবিষ্কারের কথা বলা হচ্ছে তার গুরুত্ব এ কারণে রয়েছে যে, পৃথিবীতে সমস্ত প্রাণের আবির্ভাব সম্পর্কে ধারণা পেতে এটার ভূমিকা থাকবে। ক্যারডিনাস অবশ্য নতুন করা এই গবেষণার সঙ্গে জড়িত নন, তবে স্পঞ্জের বিষয়ে তার ভালো জানাশোনা রয়েছে। 

নেচারে প্রকাশিত আলোচিত নতুন গবেষণাপত্রটি লিখেছেন কানাডার লরেনটিয়ান ইউনিভার্সিটির এলিজাবেথ টার্নার। এই গবেষণাপত্রে তিনি বলছেন, কানাডার উত্তরপশ্চিমাঞ্চলের ডাল রিফে ৮৯ কোটি বছরের প্রাচীন শিলায় জীবাশ্মসদৃশ কিছু একটা পেয়েছেন তিনি। 

বিজ্ঞানী ক্যারডিনাস বলছেন, যদি নিশ্চিত হওয়া যায় যে এগুলো স্পঞ্জজীবাশ্ম তবে অবশ্যই এটাই হবে এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে প্রাচীন কোনো প্রাণীর জীবাশ্ম। আর তার দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হবে যে ক্যামব্রিয়ানেরও ৩৫ কোটি বছরও আগে প্রাণের আবির্ভাব হয়েছিল। কিন্তু এখানেও কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। 

যে শিলাতে এই জীবাশ্ম পাওয়ার কথা বিজ্ঞানীরা বলছেন অনুবীক্ষণ যন্ত্রে তা পর্যবেক্ষণে সেখানে মিনারেল ক্যালসাইট ক্রিস্টালে আবৃত টিউব-আকৃতির অবয়ব দেখেছেন বিজ্ঞানী টার্নার। এগুলোর সাথে হর্নি স্পঞ্জের এক রকমের সাদৃশ রয়েছে। তিনি মনে করেন, প্রাচীন এই জীবাশ্মগুলো থেকেই এই হর্নি স্পঞ্জের আবির্ভাব হয়েছে।    

আধুনিক কেরাটোন স্পঞ্জের স্পঞ্জিন স্কেলেটনের অংশ

এগুলো নিয়ে অন্য কোনো ব্যাখ্যা নাকচ করে দিয়েছেন টার্নার। তিনি যা দেখছেন তাতে এর সাথে অ্যালজেয়ি, ব্যাকটেরিয়া বা ফাঙ্গির মিলও দেখছেন না তিনি। তিনি বলছেন, হর্নি স্পঞ্জের ক্ষেত্রেই আমরা এমনটা দেখি এবং স্পঞ্জ জীবাশ্মের ক্ষেত্রে যে এমনটা হয় সেটা নিয়ে এখন আর বিতর্ক নেই। 

তবে ক্যারডিনাস বলছেন, গবেষণাপত্রের শিরোনামে যেমনটা বলা হয়েছে, এটা যে স্পঞ্জজীবাশ্ম তা কিন্তু প্রমাণিত নয়। তারা কিন্তু শিরোনামেই সম্ভাব্য শব্দটা ব্যবহার করেছে। হ্যাঁ, হর্নি স্পঞ্জ বর্তমানে যেমন পাওয়া যায়, ওই ধরনেরই স্পঞ্জ প্রোটিনের সঙ্গে এর একটা সদৃশ সত্যি রয়েছে। কিন্তু গবেষকরা এ বিষয়ে এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারেননি। 

টার্নার লিখেছেন, স্পঞ্জ বা স্পঞ্জের মতো কিছু একটাই যে পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রাণী এটা তো নতুন কোনো তথ্য নয়। তা ছাড়া আজকের বিশ্বে ও যেসব প্রাণীর জীবাশ্ম পাওয়া যায় এর মধ্যে স্পঞ্জ একেবারে মৌলিক ধরনের প্রাণি। এ ছাড়াও আমি যেটা উপস্থাপন করেছি সেটার বয়স মলিকিউলার ঘড়ি থেকে ধারণা করা বয়সের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, সেখান থেকেও স্পঞ্জের ওই্ একই সময়ে বিকশিত হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। 

এর ব্যাখ্যা করে তিনি আরও লিখেছেন, জীবাশ্ম স্পঞ্জিওলোজিস্টরা ধারণা করছেন, প্রাচীন শিলাগুলোতে এ ধরনের উপাদান খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া একই ধরনের আরও কিছু কাজ থেকে এর আগেও একই ধরনের ফলাফল পাওয়া গেছে। 

ক্যারডিনাস বলছেন, পূর্বোক্ত স্টেরয়েড স্পঞ্জ যৌগের চেয়ে ২৫ কোটি বছরের পুরোরো স্পঞ্জ জীবাশ্ম পাওয়াটা এক রকমের অপ্রত্যাশিত। এত পুরোনো অন্য কিছু যৌগের সন্ধান পাওয়া গেছে আগে, কিন্তু সেগুলোকে কেই এখনও স্পঞ্জ বলে স্বীকৃতি দেয়নি। যদিও এগুলোর সঙ্গে স্পঞ্জের যে সাদৃশ রয়েছে, সেটা সবাই স্বীকার করে নিয়েছেন। 

বরং এর চেয়ে বিস্ময়কর হলো- জীবন টিকে থাকতে অক্সিজেনের যে মাত্রার প্রয়োজন পড়ে, বা আমরা মনে করি যে পরিমাণ প্রয়োজন হয়, পৃথিবীতে অক্সিজেনের পরিমাণ সেই মাত্রায় পৌঁছানোরও ৯ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে আদি স্পঞ্জের আবির্ভাব। নতুন এসব তথ্যের সত্যতা যদি নিশ্চিত করা যায়, তার অর্থ দাঁড়াবে যে, স্পঞ্জ অর্থাৎ জটিল বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রাণের আবির্ভাব হয়েছে- পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া অক্সিজেন-সংক্রান্ত দুটি বড় ঘটনার একটির অর্থাৎ নিউপ্রোটেরোজোইক অক্সিজেনেশনের আগে। পৃথিবীতে প্রাণের জন্য যে পরিমাণ অক্সিজন প্রয়োজন হয়, মনে করা হয়- এ পর্বেই সে পরিমাণ অক্সিজেনের বিস্তার লাভ করেছিল পৃথিবীতে।   

ক্যারডিনাস বলছেন, তিনি যা বলছেন, তা যদি সঠিক হয়, তবে পৃথিবীর আদিপ্রাণীগুলোর আবির্ভাব  নিউপ্রোটেরোজোইক অক্সিজেনেশনের আগে হয়েছে, এবং তাদের সম্ভবত কম অক্সিজেনে বেঁচে থাকার ক্ষমতা ছিল। 

নতুন এ গবেষণা থেকে এ ইঙ্গিতও পাওয়া যায় যে, ৭২ কোটি থেকে সাড়ে ৬৩ কোটি বছরে আগে পৃথিবীতে যে বরফ যুগ এসেছিল তাতে পৃথিবী থেকে সব প্রাণ নির্মূল হয়নি।  কথিত এই বরফ যুগ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বলা হয়ে থাকে ‘স্নোবল আর্থ’ নামের এ পর্বে পুরো ভূপৃষ্ঠ বরফে ঢেকে গিয়েছিল। 

নতুন এ ব্যাখ্যাগুলোকে সঠিক ধরে নেওয়া হলে অর্থ দাঁড়ায় যে, আজ থেকে ৮৯ কোটি বছর আগেও পৃথিবীতে স্পঞ্জের অস্তিত্ব ছিল। ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে যে, তাহলে আরও কত আগে থেকে পৃথিবীতে স্পঞ্জের অস্তিত্ব ছিল? আর নতুন গবেষণা থেকে যেসব ইঙ্গিত পাওয় যায় তাতে বোঝা যায় যে, অক্সিজেনের ঘাটতি ও শক্তিশালী বরফ যুগেও দিব্যি টিকে ছিল এই প্রাণিরা। ফলে এরা যে আরও অনেক আগে থেকে পৃথিবীতে টিকে ছিল সে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।  

অনুবাদ : নাঈম ফেরদৌস রিতম। 

সূত্র : গিজমোডো। 

এনএফ