ইরাক: ধৈর্যের খেলায় লাভবান হচ্ছে ইরান

প্রথমে আফগানিস্তান, তারপর ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত। ইরাকের প্রধানমন্ত্রীর সাথে সোমবার হোয়াইট হাউসে বৈঠকের পর প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা করেন- চলতি বছর শেষ হওয়ার আগেই ইরাক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের ফিরিয়ে নেওয়া হবে। এরপর মার্কিন সৈন্যরা সেদেশে কোনো সামরিক তৎপরতায় অংশ নেবে না।

এই সিদ্ধান্তে তাৎক্ষণিক ভাবে দু’টি প্রশ্ন সামনে এসেছে। আর সেটা হচ্ছে- মার্কিন সৈন্য চলে গেলে ইরাকে কী পরিবর্তন হবে এবং ইসলামিক স্টেট (আইএস) কি নতুন করে ইরাকে তৎপর হয়ে উঠবে?

এখন থেকে ১৮ বছর আগে সামরিক অভিযানে ইরাক দখলের পর সেদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৬০ হাজার। সরাসরি সামরিক তৎপরতায় অংশ নিচ্ছে বা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত তেমন মার্কিন সৈন্যের সংখ্যা এখন মাত্র ২ হাজার ৫০০। এছাড়া, আইএস’র মোকাবিলায় বেশ কিছু মার্কিন স্পেশাল ফোর্স ইরাকে তৎপর রয়েছে। যদিও তাদের সংখ্যা অজানা।

ইরাকে মার্কিন সৈন্যদের এখন প্রধান কাজ ইরাকি সৈন্যদের প্রশিক্ষণ এবং অন্যান্যভাবে সাহায্য করা। কিন্তু ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা উপস্থিতি নিয়ে বিরোধিতা ক্রমেই বাড়ছে। ইরান-সমর্থিত রাজনীতিক এবং মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো এ ব্যাপারে বিশেষ তৎপর। তারা চায় এখনই মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে।

বিশেষ করে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে বাগদাদ বিমানবন্দরের কাছে মার্কিন ড্রোন হামলায় ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ডের প্রভাবশালী এক কম্যান্ডার মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানির মৃত্যুর পর মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জোরদার হয়েছে।

ফলে, যুক্তরাষ্ট্রে যারা ইরাক থেকে সৈন্য ফিরিয়ে আনার পক্ষে তারাও এই চাপ নিয়ে তেমন অখুশি নন। যদিও ইরাককে ইরানের হাতে তুলে দিতে তারা কেউই চান না, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা বেশ কিছুদিন ধরেই চাইছেন মধ্যপ্রাচ্যের ‘অবিরাম যুদ্ধ’ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে ধীরে ধীরে সরিয়ে নিতে।

সে কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এবং মিত্ররা প্রায় তড়িঘড়ি করে আফগানিস্তান থেকে সরে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র এখন নজর দিতে চায় এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে এবং দক্ষিণ চীন সাগরে।

যদিও কিছু আমেরিকান সৈন্য ইরাকে রয়ে যায়, কিন্তু ইরাকের জটিল রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং সীমান্তের ওপারে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ আইএসকে দারুণ সুবিধা করে দেয়। তারা ইরাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মসুলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং তারপর সেখান থেকে ইরাক এবং সিরিয়ায় বিশাল একটি এলাকার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে সমর্থ হয়।

আবারও কি সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে? ইরাকি সেনাবাহিনীর ওপর থেকে আমেরিকান সামরিক সমর্থন চলে গেলে কি আইএস’র পুনরুজ্জীবন হতে পারে? ২০১১ সালের তুলনায় সেই সম্ভাবনা এখন অনেক কম। অবশ্য তার কতগুলো কারণ রয়েছে।

সে সময় ইরাকে শিয়াদের প্রতি প্রধানমন্ত্রী নুরী আল মালিকী সরকারের একতরফা পক্ষপাতিত্ব নিয়ে সুন্নিদের মধ্যে দারুণ ক্ষোভ তৈরি হয়। আইএস সেই ক্ষোভকে কাজে লাগায়। মালিকি ২০০৬ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত শাসনামলে ইরাকি সুন্নিদের এতটাই কোণঠাসা করে ফেলেন তারা অনেকেই আইএস’র শিবিরে গিয়ে আশ্রয় নেয় বা নিতে বাধ্য হয়।

তৃতীয়ত, আইএস’র নীতি-নির্ধারকদের মধ্যে যারা এখনও অবশিষ্ট রয়েছেন তারা টিকে থাকার কৌশল হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে ছেড়ে আফ্রিকা এবং আফগানিস্তানের অরক্ষিত অঞ্চলে ঘাঁটি তৈরির পথ নিয়েছেন।

গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট ফর ষ্ট্রাটেজিক স্টাডিজের বিশ্লেষক হিসাবে বর্তমানে কাজ করছেন ব্রিটেনের সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার বেন ব্যারি। তিনি বলছেন, ‘আইএসকে মোকাবিলা করার ক্ষমতা এখন ইরাকি সরকারি বাহিনীর রয়েছে। তবে ইরাকের সুন্নিদের ব্যাপারে একটি রাজনৈতিক সমাধান না হলে বিদ্রোহী তৎপরতার মৌলিক কারণগুলো থেকে যাবে।’

আইএস যে ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে ইরাক ও সিরিয়ার বিশাল এলাকায় ঝড়ের গতিতে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে সমর্থ হয়েছিল তার অন্যতম কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা দেশগুলো ইরাকের ওপর থেকে নজর সরিয়ে নিয়েছিল। এরপর, আইএসকে পরাজিত করতে পশ্চিমা শক্তিগুলো এবং তাদের মিত্রদের পাঁচটি বছর এবং শত শত কোটি ডলার ব্যয় করতে হয়েছে।

ব্রিগেডিয়ার বেন ব্যারি বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি দেখে যে ইরাকে বসে আইএস ইরাকের বাইরে মার্কিন স্বার্থে আঘাত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাহলে আমেরিকা হয়ত একাই আবারও সামরিক হামলা চালাবে। তার মতে, পারস্য উপসাগরে এবং আশপাশের দেশে এখনও যে সামরিক জনবল এবং রসদ আমেরিকার মজুদ রয়েছে, তাতে খুব সহজেই ইরাকে নতুন করে কোনো সামরিক তৎপরতা শুরু আমেরিকার জন্য তেমন কোনো কঠিন কাজ হবে না।

ইরানের ধৈর্যের খেলা
যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা চলে গেলে ইরাকে দীর্ঘমেয়াদে যে বাস্তবতা তৈরি হবে, তাতে যে ইরানের লাভ হবে তা নিয়ে তেমন কোনো সন্দেহ নেই। ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরানের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য আশপাশের দেশ ও অঞ্চল থেকে মার্কিন সেনাদের বিদায় করা যাতে তারাই এই অঞ্চলে প্রধান শক্তি হতে পারে।

ইরানের প্রভাব বলয় প্রসারের পেছনে একসময় বড় বাধা ছিলেন সাদ্দাম হোসেন। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসনে তার পতনের পর ইরান রাতারাতি যে সুবিধা পেয়ে যায় তা কাজে লাগানোর চেষ্টা তারা তখন থেকেই অব্যাহত রেখেছে।

ইরাকে একাধিক শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী তৈরি এবং তাদের শক্তি বৃদ্ধিতে দারুণ সাফল্য দেখিয়েছে ইরান। ইরাকি পার্লামেন্টের ভেতর ইরানের পক্ষে কথা বলার মত অনেকগুলো প্রভাবশালী কণ্ঠ রয়েছে। এরপর সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ ইরানকে সেদেশে সামরিক উপস্থিতির সুযোগ তৈরি করে দেয়। এছাড়া পাশের দেশ লেবাননে ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ দেশটির সবচেয়ে বড় সামরিক শক্তি।

ফলে, মার্কিন ঘাঁটিতে থেকে থেকে রকেট হামলা এবং সেই সাথে ইরাকের রাস্তার যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য উপস্থিতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে সমর্থন জোগাচ্ছে ইরান। এখন, ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে তেহরানে অনেকেই মনে করবেন তারা সঠিক পথেই রয়েছেন এবং পরিস্থিতি তাদের পক্ষেই রয়েছে।

টিএম