আসাম-মিজোরামের মধ্যে রক্তক্ষয়ী লড়াই কেন?
সম্প্রতি লাদাখ সীমান্তে রক্তক্ষয়ী এক সংঘর্ষে জড়িয়েছিল ভারতীয় ও চীনের সেনারা। তবে সেটা ছিল দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ। কিন্তু রোববার ভারতের আসাম ও মিজোরামের পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে আসামের ছয় পুলিশের মৃত্যু হলো কেন?
সীমানা নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরে দুই রাজ্যের পুলিশের লড়াই ও মৃত্যুর ঘটনা সেই ১৯৮৫ সালের পর আবার হলো। তখন সীমানা নিয়ে বিরোধে জড়িয়েছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের দুই রাজ্য আসাম ও নাগাল্যান্ড। এবার রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়েছে আসাম ও মিজোরাম।
বিজ্ঞাপন
বস্তুত আসামের সঙ্গে নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম ও অরুণাচল প্রদেশের সীমানা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক ও বিরোধ রয়েছে। এমনকি সেই বিরোধ অতীতে আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। আসাম ও মিজোরামের মধ্যে বিরোধের একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে যা রয়েছে এর নেপথ্যে।
আসাম ও মিজোরামের মধ্যে সেই বিরোধ মূল থেকে না মিটিয়ে জোড়াতালি দিয়ে সাময়িকভাবে মেটানোর ইতিহাসও আছে। তার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে রাজনীতি, ভোট পাওয়ার অংক আর কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের কোনো একটি রাজ্যে জনপ্রিয়তা না হারাবার প্রয়াস।
ভারতে এক রাজ্য ভেঙে দুই রাজ্য গঠনের অনেক উদাহরণ আছে। উত্তরপ্রদেশ ভেঙে উত্তরাখণ্ড হয়েছে, মধ্যপ্রদেশ ভেঙে ছত্তিশগড় ও বিহার ভেঙে ঝাড়খণ্ড। তারও আগে মহারাষ্ট্র ভেঙে হয়েছিল গুজরাট ও গোয়া। কিন্তু কোথাও সীমানা নিয়ে কোনো গোলমাল হয়নি।
ভারতে দুই রাজ্যের মধ্যে নদীর জলের বণ্টন নিয়ে বিরোধ হয়েছে। দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের একাধিক রাজ্য জড়িয়েছে এমন বিরোধে। কিন্তু সেই বিরোধের জেরে দুই রাজ্যের পুলিশ নিজেদের মধ্যে লড়াই করছে এমনটা হয়নি; যা গতকাল হতে দেখা গেল।
কিছুদিন আগে উত্তরপ্রদেশ ও রাজস্থান সীমানায় কৃষকদের আটকে দেওয়া নিয়ে কিছুটা উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল দুই রাজ্যের। করোনা নিয়ে লকডাউনের সময় পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে সীমানা বন্ধ করে দেয় ওড়িশা। তাতে অনেকে পশ্চিমবঙ্গে ফিরতে পারছিলেন না।
তাহলে উত্তর পূর্বের দুই রাজ্যের মধ্যে গোলমালটা এই জায়গায় গেল কেন? এর উত্তর খোঁজার আগে বিরোধের ইতিহাসটা দেখে নিতে হবে। বিরোধের শুরু ব্রিটিশ আমলে। উনিশ শতকে বরাক ভ্যালিতে ব্রিটিশরা চা বাগান করে। বাগান সম্প্রসারণ করতে গিয়েই বিরোধ।
ব্রিটিশদের বাগান সম্প্রসারণের বাধা দেয় মিজোরা। ১৮৭৫ সালে আসাম গেজেটে জেলার সীমানা নির্ধারণ করে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। মিজো উপজাতি প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে কাছার ও লুসাই হিলসের সীমানা বেধে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও বিরোধ নিষ্পত্তি হয়নি।
স্বাধীনতার পর আসাম ভেঙে একের পর এক রাজ্য গঠিত হয়। তখন আসাম ও মিজোরামের মধ্যে সমঝোতা হয় যে, দুই রাজ্যের নো ম্যানস ল্যান্ডে কেউ কোনো নির্মাণ করবে না। কিন্তু ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এমজেডপি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন কৃষকদের জন্য নো ম্যানস ল্যান্ডে একটি রেস্ট হাউস তৈরি করে। আসাম পুলিশ সেটা ভেঙে দেয়। শুরু হয় ঝামেলা।
আবার গত অক্টোবরে লায়লাপুরে একটি নির্মাণ নিয়ে বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। ওই এলাকাটি মিজোরাম নিজেদের বলে দাবি করে। এবারও বিরোধের মূল কারণ, নো ম্যানস ল্যান্ডে নির্মাণ নিয়ে। আসাম বলছে, অরুণাচল জঙ্গল কেটে রস্তা বানাচ্ছে পুলিশের ক্যাম্প বসানোর জন্য। আর অরুণাচল দোষ দিচ্ছে আসামকে।
ঘটনা হলো, উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলোর মধ্যে সীমানা নিয়ে এই বিরোধের দীর্ঘ ইতিহাস সত্ত্বেও তা মেটাবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে সেভাবে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। জোড়াতালি দিয়ে সমস্যা মেটানোর চেষ্টা হয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে দুই রাজ্যের মধ্যে জল বা সীমানা যে কারণেই কোনো বিরোধ হোক না কেন, কেন্দ্রীয় সরকার নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করে। কারণ এক রাজ্যের দিকে গেলে অন্য রাজ্যের মানুষ রেগে যাবে। আর এগুলো হলো আবেগের বিষয়। ফলে তার প্রভাব পড়বে ভোটে।
ভারতের বর্তমান বিরোধীদল কংগ্রেসের সেই অভিজ্ঞতা আছে। অন্ধ্রপ্রদেশের মানুষের রায় উপেক্ষা করে রাজ্য ভাগ করার পর কংগ্রেস সেখান কার্যত বিলীন। আগে যে রাজ্যে সিংহভাগ আসনে জিতত, এখন সেখানে প্রায় সব কেন্দ্রেই কংগ্রেসের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়।
তাই কেন্দ্রীয় সরকারের বরাবরের মনোভাব হল, বিতর্কটা যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ধামাচাপা দেওয়া। আসাম ও মিজোরাম বিরোধের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। গত জুনেও আসাম ও মিজোরামের মধ্যে সীমানা বিরোধ হয়েছিল। তিন দিন আগে উত্তর-পূর্ব ভারতের সব মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সেখানে তিনি এই দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে বলেছেন, বিরোধ মিটিয়ে নিন। সোমবারও মিজোরামের জোরামথাঙ্গা এবং আসামের হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে একই পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। তার বেশি কিছু নয়।
দুই রাজ্যেই বিজেপি ক্ষমতায় আছে। মিজোরামে জোরামথাঙ্গার এমএনএফের সঙ্গে তাদের জোট। আসামে বিজেপি নিজেই ক্ষমতায়। এখন আসামের পক্ষ নিয়ে কিছু বললে মিজোরাম হাতের বাইরে চলে যাবে। তার প্রভাব পড়তে পারে উত্তর-পূর্বের অন্য রাজ্যগুলোতে।
লোকসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রতিটি আসনের জন্য আলাদা পরিকল্পনা করেন মোদি-শাহ জুটি। তাই তারা এমন কিছু করবেন না, যাতে কোনো রাজ্যের মানুষ তাদের উপর ক্ষেপে যায়। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর অবস্থানগত গুরুত্বও অপরিসীম। কারণ চীন সীমান্ত কাছেই। বাংলাদেশের সীমান্তও পাশে। ফলে অসম্ভব ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে এই এলাকার।
সূত্র: ডয়েচে ভেলে
এএস