১৬ বছর পর জার্মানির চ্যান্সেলর পদ থেকে বিদায় নিচ্ছেন মেরকেল

আগামী সেপ্টেম্বর মাসে জার্মানিতে ফেডারেল পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ক্ষমতাসীন দল সরকার গঠন করলেও চ্যান্সেলর হিসেবে আসছেন নতুন কেউ। কারণ অ্যাঙ্গেলা মেরকেল আগেই জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি আর এই পদে লড়ছেন না। তার জায়গা পূরণে তিন প্রধান দল ইতোমধ্যেই তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে।

১৬ বছর পর জার্মানির চ্যান্সেলর পদ থেকে বিদায় নিচ্ছেন মেরকেল। তার সম্ভাব্য উত্তরসূরি তিনজন। তাদের কার রাজনৈতিক অবস্থান কেমন? জলবায়ু নীতি কিংবা অভিবাসন নিয়ে জার্মান পার্লামেন্টে অবস্থানই বা কেমন ছিল?

মেরকেলের নিজের দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) মনোনয়ন দিয়েছে আরমিন লাশেটকে৷। তিনি দেশটির সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ নর্থ-রাইন ওয়েস্টফালিয়ার মুখ্যমন্ত্রী। অন্যদিকে গ্রিন পার্টি প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে ৪০ বছর বয়সী আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ আনালেনা বায়েরবোককে। আর দ্য সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটসদের (এসপিডি) প্রার্থী বর্তমান অর্থমন্ত্রী ওলাফ শলৎস।

সরকার গঠনে জার্মানিতে সাধারণত একাধিক দল মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জোট গঠন করে। এরপর তারা নিজেদের মধ্য থেকে চ্যান্সেলর নির্বাচন করে। কে হবেন নতুন চ্যান্সেলর সেটি নির্ভর করবে পরবর্তী জোটের ধরনের ওপরে। মেরকেল সরকারের জোটে ছিল সিডিইউ/সিএসইউ ও এসপিডি। গ্রিন পার্টি পালন করেছে বিরোধী দলের ভূমিকা।

এই সময়ে পার্লামেন্টে শরণার্থী, জলবায়ু ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সম্পর্কিত বিভিন্ন নীতিতে এই দলগুলো আর পরবর্তী চ্যান্সেলর প্রার্থীরা কী ধরনের অবস্থান নিয়েছেন তা বিশ্লেষণ করেছে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে।

শরণার্থী নীতি
দেড় দশকের বেশি সময় সরকার প্রধান থাকাকালে ২০১৫ সালে হাঙ্গেরিতে আটকে থাকা শরণার্থীদের জন্য দুয়ার খুলে দিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসেন মেরকেল। পার্লামেন্টে মেরকেলের দলের ভোট রেকর্ড থেকে দেখা যায়, তাদের এক-চতুর্থাংশ আরও উদার অভিবাসন নীতিতে বিশ্বাস করে।

তবে তার জোট ২০১১ সালে সিরীয় শরণার্থীদের বের করে দেওয়ার উদ্যোগ বন্ধের একটি প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। এই প্রস্তাবটি তুলেছিল গ্রিন পার্টি। বায়েরবোক ও তার দল বরাবরই উদার শরণার্থী নীতির পক্ষে ভোট দিয়েছে।

২০২০ সালে গ্রিসে শরণার্থী ক্যাম্পে আগুন লাগার প্রেক্ষিতে জার্মানির আরও শরণার্থী গ্রহণের পক্ষে কথা বলেছেন এসপিডির রাজনীতিকরা। সেই সঙ্গে ২০১৫ ও ২০১৬ সালের শরণার্থী স্রোতের সময় দ্রুত আবেদন নিষ্পত্তি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সমন্বয় বাড়ানোর ওপর জোর দেন তারা।

কিন্তু একইসঙ্গে ইইউ সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে কড়াকড়ি আরোপ ও প্রত্যাখ্যাত হওয়া অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বিতাড়ন প্রক্রিয়া কঠোর করারও প্রস্তাব এসেছে তাদের কাছ থেকে।

অন্যদিকে এই বিষয়ে আরমিন লাশেট বরাবরই মেরকেলকে সমর্থন দিয়ে এসেছেন। ২০১৫ সালে শরণার্থীনীতি নিয়ে মেরকেল দলের ভেতরে ও বাইরে যখন চাপের মুখে, সেসময়ও পাশে থেকে তাকে সমর্থন যুগিয়েছেন লাশেট। বিপরীত দিক থেকে মেরকেল যখন কড়া অবস্থান গ্রহণ করেছেন তখন তার পক্ষেও অবস্থান নিয়েছেন তিনি।

বিদেশে সামরিক মিশন

জার্মানির সৈন্যরা বর্তমানে সারা বিশ্বে ১২টি মিশনে নিযুক্ত আছে। সেনাবাহিনীর বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত সরকার নিয়ে থাকলেও তা অনুমোদন নিতে হয় পার্লামেন্ট থেকে।

বিরোধী দল হিসেবে গ্রিন পার্টি এর কয়েকটিতে মাত্র সমর্থন দিয়েছিল। এছাড়া উদাহরণ হিসেবে বায়েরবোক বরাবরই ভূমধ্যসাগরের নিরাপত্তায় ন্যাটোর ‘সি গার্ডিয়ান অপারেশন’-এ জার্মানির সামরিক অংশগ্রহণের বিরোধী ছিলেন। একইভাবে ইরাক ও সিরিয়া মিশনেরও সমর্থন দেননি তিনি। তবে উত্তর আফ্রিকা ও লেবানন মিশনের পক্ষে অবস্থান নেন তারা।

গ্রিন পার্টির জলবায়ু নীতি
গ্রিন পার্টির প্রধান রাজনৈতিক ইস্যু জলবায়ু। বুন্ডেসটাগে এ সংক্রান্ত অনেক প্রস্তাব হাজির করেছে তারা। ২০২২ সালের মধ্যে কয়লার ব্যবহার সম্পূর্ণ বন্ধ করা তার একটি। পাশাপাশি সরকারের জলবায়ু নীতি বিষয়ক বিভিন্ন উদ্যোগেও দলটি সমর্থন দিয়ে এসেছে। যেসব ক্ষেত্রে উদ্যোগগুলো যথেষ্ট নয় বলে মনে করেছে, সেখানে বিরোধিতা করেছে দলটি।

অন্যদিকে গ্রিন পার্টির অর্ধেকের বেশি জলবায়ু প্রস্তাব মেরকেল ও তার জোট সমর্থন করেছে। জলবায়ু সুরক্ষা কর্মসূচী ২০৩০, বিমান শিল্পের ওপর কর বৃদ্ধি করা তারই কিছু উদাহরণ। আবার বিপরীত দিক থেকে মেরকেল ও তার দল সৌরবিদ্যুতে ভর্তুকির বিপক্ষেও ভোট দিয়েছে।

জলবায়ু নিয়ে লাশেটের দ্বিধা

পার্লামেন্টে ভোটের রেকর্ড থেকে জলবায়ু নীতি নিয়ে লাশেট বা শলৎসের অবস্থান সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। তবে জলবায়ু ইস্যুতে অল্প কয়েকটি ভোটের মধ্যে লাশেট প্রাণিকল্যাণ ও পরিবেশ সংরক্ষণ নীতির বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন।

জনসম্মুখে জলবায়ু নীতি নিয়ে তাকে বেশ দ্বিধাগ্রস্ত মনে হয়। তার নিজের প্রদেশ নর্থ রাইন ওয়েস্টফালিয়া কয়লাই প্রধান জ্বালানি হিসেবে ভূমিকা রাখছে। যে কারণেই হয়তো জলবায়ু নিয়ে আলোচনায় তিনি বরাবরই শিল্প ও অর্থনীতির ওপর গুরুত্বারোপ করেন।

ইইউ নিয়ে অবস্থান
পার্লামেন্টে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিষয়ক বিভিন্ন প্রস্তাব সাধারণত সরকার দলীয় জোটই উপস্থাপন করে আর সেগুলো সহজেই পাস হয়। এক্ষেত্রে গ্রিন পার্টি নিজেরা উদ্যোগী না হলেও বিভিন্ন সময়ে সিপিইউ/সিএসইউ-এর প্রস্তাবগুলোকে সমর্থন দিয়েছে।

এরমধ্যে গ্রিসের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা থেকে শুরু করে আলবেনিয়াকে ইইউতে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ২০১৯ সালের আলোচনা বা ২০২০ সালের ইইউর মহামারি সহায়তা তহবিলে অংশগ্রহণের মতো বিষয়গুলো রয়েছে।

বিরোধী দলে থাকা সত্ত্বেও গত কয়েক বছরে গ্রিন পার্টি যেভাবে সরকারি জোটকে সমর্থন যুগিয়েছে তাতে অনেকটা বিস্মিত ইউনিভার্সিটি অব বামবের্গের অধ্যাপক উলরিশ সিবেরের।

তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে তারা ভবিষ্যত সরকারে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। আপনি যদি পরবর্তীতে একসাথে তাদের সঙ্গে সরকার চালাতে চান তাহলে সবকিছুতে বিরোধিতা করতে পারবেন না।’

টিএম