কানাডায় আরও ১৬০টি গণকবরের সন্ধান
কানাডায় ফের দেড় শতাধিক গণকবরের সন্ধান মিলেছে। সম্প্রতি দেশটির পশ্চিম উপকূলে, কুপার দ্বীপের একটি পরিত্যাক্ত আদিবাসী আবাসিক স্কুল সংলগ্ন এলাকায় সম্প্রতি ১৬০ টি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে দ্বীপটির প্রশাসনিক কর্মকর্তারা।
কানাডার পশ্চিম উপকূলীয় এই দ্বীপটির অধিকাংশ বাসিন্দা দেশটির আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ান জাতির পেনেলাকুট গোত্রভুক্ত। মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে গোত্রের নেতারা জানিয়েছেন, দ্বীপের যে আবাসিক স্কুলের কাছে এই গণকবরসমূহের সন্ধান পাওয়া গেছে, সেটির নাম কুপার আইল্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল। ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল স্কুলটি, প্রায় ৮৫ বছর চলার পর ১৯৭৫ সালে বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবারের বিবৃতিতে পেনেলাকুট গোত্রের নেতারা বলেন, ‘দফায় দফায় এমন শত শত গণকবরের সন্ধান আমাদের আড়ষ্ট করে তুলছে। অতীতে আমাদের পূর্বপূরুষদের সঙ্গে যে ভয়াবহ ও নৃশংস আচরণ, অবিচার করা হয়েছিল, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই গণকবরসমূহ।’
‘কানাডায় আমাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মের বহু মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন। সন্ধান প্রাপ্ত গণকবরসমূহ তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। এখন আমাদের ভয় পাওয়া বা বিষন্নতার সময় নয়, বরং নিজের অতীত সম্পর্কে অনুপুঙ্খভাবে জানার সময়।’
কানাডায় প্রথম আদিবাসী গণকবরের সন্ধান মেলে চলতি বছর ২৯ মে। দেশটির ব্রিটিশ কলাম্বিয়া রাজ্যের কামলুপস এলাকার একটি পরিত্যাক্ত আবাসিক স্কুল থেকে ২১৫ জন আদিবাসী শিশুর দেহাবশেষ উদ্ধার হয় ওই দিন। দেহাবশেষগুলোর মধ্যে ৩ বছর বয়সী শিশুর দেহাবশেষও ছিল।
এ ঘটনায় তোলপাড় শুরু হয় দেশটিতে। তারপর জুন মাসে একে একে কানাডার সাসকাচুয়ান, অ্যালবার্টা, মানিতোবা ও ব্রিটিশ কলম্বিয়া রাজ্যে আরও কয়েক শ’গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়। দেশটির আদিবাসী নেতারা জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত কানাডায় ৮ শতাধিক আদিবাসী গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব অঞ্চলের আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষজনকে হত্যার পর এই গণকবরগুলোতে তাদের মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল। কানাডার আদিবাসী অধিকার সংস্থা দ্য ফেডারেশন অব সোভারিজিন ইন্ডিজেনাস নেশনস দেশটির সরকারের প্রতি এ বিষয়ক আরও বিস্তিৃত অনুসন্ধানের দাবি জানিয়েছে।
সংস্থাটির বক্তব্য, সঠিকভাবে অনুসন্ধান করা হলে কানাডাজুড়ে এমন আরও বহু গণকবরের সন্ধান পাওয়া যাবে।
পঞ্চদশ শতকে স্পেনীয় অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস যখন প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে আমেরিকায় পৌঁছেছিলেন, তখন তিনি ভুলক্রমে ভেবেছিলেন যে ভারতে উপস্থিত হয়েছেন। সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের তিনি অভিহিত করেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান’ হিসেবে।
গায়ের রঙে লালচে ভাব থাকায় সেই থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার স্থানীয় আদিবাসীদের ‘রেড ইন্ডিয়ান’ জাতি নামেই চিনে আসছে বিশ্ববাসী। তবে কানাডায় রেড ইন্ডিয়ানের পাশাপাশি ইনুইট ও মেটিজ জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরও বসবাস ছিল।
দেশটির ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, অষ্টাদশ শতকের শেষ থেকে উনবিংশ শতকের শুরুর দিকে যখন কানাডায় দলে দলে ইউরোপীয় বসতকাররা (সেটলার) আসতে থাকে তখন দেশটির স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ান, ইনুইট ও মেটিজ জাতিগোষ্ঠীর গোত্রসমূহের সঙ্গে তাদের বেশ কয়েকটি সংঘাত হয়েছিল। ইউরোপীয় বসতকারদের হাতে উন্নত অস্ত্র ও প্রযুক্তি থাকায় সবগুলো সংঘাতেই শোচনীয় পরাজয় ঘটেছিল আদিবাসীদের।
পরাজিত আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে হত্যা করে মাটিচাপা দিয়েছিল বসতকাররা। বাকি যারা বেঁচে ছিলেন, তাদের খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষাদান ও ‘অধিকতর সভ্য’ করে তুলতে ১৮০০ সালের পর থেকে দেশটির প্রধান ক্যাথলিক গির্জার অধীনে কানাডাজুড়ে বিভিন্ন আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা শুরু হয়।
দেশটির আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সে সময় দেশটিতে ১৩৯ টি এ রকম আবাসিক স্কুল ছিল। কানাডার কেন্দ্রীয় ক্যাথলিক গির্জার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুলসমূহ পরিচালনা করতেন ক্যাথলিক খ্রিস্টান মিশনারিরা।
কয়েক লাখ আদিবাসী শিশুকে জোরপূর্বক তাদের বাবা-মা ও অভিভাবকদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভর্তি করা হয়েছিল এসব স্কুলে। নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলা ও নিজেদের ধর্মবিশ্বাস চর্চা নিষিদ্ধ ছিল এই শিশুদের জন্য। তাদের সঙ্গে আচরণ করা হতো ক্রীতদাসের মতো এবং স্কুল শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষের হাতে নিয়মিত শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।
পাশাপাশি আদিবাসীদের সংস্কৃতি ও জীবনযাপন নিয়ে কটাক্ষ ও ব্যাঙ্গ করাও ছিল সেই স্কুলগুলোর নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ। সহ্যের অতীত নির্যাতনের ফলে বহু শিশুর মৃত্যু হতো। তখন তাদেরকে মাটিচাপা দেওয়া হতো। এসব সমাধিই এখন গণকবর।
দেশটির আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৮০০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠা করা শুরু এসব স্কুল এবং সর্বশেষ স্কুলটি বন্ধ ঘোষণা করা হয় ১৯৯৬ সালে।
কানাডার কেন্দ্রীয় সরকার যদিও দেশের ইতিহাসের এই অন্ধকারচ্ছন্ন অধ্যায়ের জন্য ২০০৮ সালে আদিবাসীদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে, কিন্তু এসব আবাসিক স্কুল পরিচালনার দায়িত্বে যে প্রতিষ্ঠানের হাতে ছিল, সেই প্রধান ক্যাথলিক চার্চ এখন পর্যন্ত এজন্য ক্ষমা বা দুঃখ প্রকাশ করেনি।
এদিকে, গত ২৯ মে কামলুপসে যখন প্রথম গণকবরের সন্ধান মেলে, সে সময়েই দেশটির আদিবাসী অধিকার সংস্থা দ্য ফেডারেশন অব সোভারিজিন ইন্ডিজেনাস নেশনসের নেতারা এসব স্কুল প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থা এবং এখন পর্যন্ত জীবিত সব ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনার দাবিতে সোচ্চার অবস্থান নিয়েছেন।
সূত্র : আল জাজিরা
এসএমডব্লিউ