টানা প্রায় ৭ মাস ব্যাপক বিধ্বংসী সেনা অভিযান চালানোর পর অবশেষে তাইগ্রে প্রদেশে সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছে ইথিওপিয়ার কেন্দ্রীয় সরকার। সোমবার দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমে এ সংক্রান্ত একটি বিবৃতি দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে।

এদিকে, সোমবারই তাইগ্রে প্রদেশের রাজধানী মেকেলের দখল নিয়েছে ইথিওপিয়ার কেন্দ্রীয় সরকারবিরোধী সশস্ত্র রাজনৈতিক দল তাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্ট (টিপিএলএফ)। ফলে, ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদের নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার স্বপ্রণোদিত হয়ে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছেন, না কি পরিস্থিতিগত কারণে করতে বাধ্য হয়েছেন- তা এখনও স্পষ্ট নয়।

সোমবার তাইগ্রের রাজধানী মেকেলেতে টিপিএলএফ যোদ্ধাদের প্রবেশ এবং সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়োগ দেওয়া ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তার ভবন দখল করার পরই অনেকটা তড়িঘড়ি করে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা বিষয়ক বিবৃতিটি দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘কৃষি উৎপাদনের বিষয়টি বিবেচনা করে তাইগ্রে প্রদেশে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। ২৮ জুন থেকে এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। কৃষি মৌসুম শেষ হওয়া পর্যন্ত এই যুদ্ধ বিরতি চলবে।’

মে থেকে সেপ্টেম্বর- এই পাঁচ মাসকে ইথিওপিয়ার কৃষি মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। এই সময়সীমার মধ্যেই দেশটির কৃষকরা ফসল বপন ও পরিপক্ক হওয়ার পর তা ঘরে তোলেন। ইথিওপিয়ার ৯০ ভাগ কৃষি উৎপাদন হয় এই পাঁচ মাসে।

যুদ্ধবিরতির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র ও সামরিক বাহিনীর মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা নেটওয়ার্ক, কিন্তু তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এদিকে, টিপিএলএফ-এর মুখপাত্র গেটাশিও রেডা তাইগ্রের রাজধানী নিজেদের দখলে নিয়ে আসার ব্যাপারটি বার্তাসংস্থা রয়টার্সের কাছে স্বীকার করেছেন। স্যাটেলাইট ফোনে রয়টার্সের প্রশ্নের উত্তরে গেটাশিও রেডা বলেন, ‘তাইগ্রের রাজধানী, মেকেলে, বর্তমানে আমাদের নিয়ন্ত্রণে।’

তবে কেন্দ্রীয় সরকারের যুদ্ধবিরতির ঘোষণায় টিপিএলএফ এর প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনিও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আল জাজিরার প্রতিনিধি ম্যালকম ওয়েব জানিয়েছেন, টিপিএলএফ মেকেলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর সেখানকার জনগণের মধ্যে ব্যাপক উচ্ছাস লক্ষ্য করা গেছে। মেকেলের সড়কগুলোতে আনন্দ মিছিল বের করেছেন অনেকে, কেউ বা আতশবাজি ফোটাচ্ছেন।

গত বছরের নভেম্বরে তাইগ্রেতে ইথিওপিয়ার একটি সামরিক ঘাঁটিতে আকস্মিক হামলা হয়। হামলার পর দেশটির উত্তরাঞ্চলীয় এই প্রদেশের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তাইগ্রে পিপলস লিবারেশন ফ্রন্টকে (টিপিএলএফ) ক্ষমতাচ্যুত করে সেখানে আইনের শাসন ফেরাতে সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন আবি আহমেদ, যিনি ২০২০ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

প্রাদেশিক রাজধানী মেকেলে থেকে টিপিএলএফের নেতাদের উৎখাতের পর অভিযান সফল হয়েছে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে তাইগ্রেতে আদ্দিস আবাবার অনুগত অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন নিয়োগ দেন আবি আহমেদ। তারপর এই অঞ্চলে বেসামরিক লোকজনদের লক্ষ্য করে চালানো হয় ব্যাপক সহিংসতা ও গণহত্যা।

বেলজিয়ামের ইউনিভার্সিটি অব ঘেন্টের একদল গবেষক ইথিওপিয়ার উত্তরাঞ্চলের তাইগ্রে সংঘাত নিয়ে গবেষণা করেছেন। সেই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক বছরে সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সদস্যরা তাইগ্রেতে অন্তত ১৫০ টি গণহত্যা চালিয়েছেন; এবং এই গণহত্যায় নিহত হয়েছেন প্রায় ২ হাজার মানুষ। নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক নারী-শিশু ছাড়া ৯০ এর অধিক বয়সী বৃদ্ধও আছেন। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান বলছে, যুদ্ধের সময় বেসামরিক নাগরিকদের গণহত্যার সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ রেকর্ড এটি।

তাইগ্রেতে ইথিওপিয়ার সামরিক বাহিনী সর্বশেষ হামলা করেছে গত ২২ জুন। প্রদেশটির তোগোগা শহরের একটি মার্কেটে সামরিক বাহিনীর বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৬০ জন মানুষ, আহত হয়েছেন আরও কয়েক শত।

চলমান করোনা মহামারির মধ্যে টানা যুদ্ধ ও সংঘাতের কারণে ব্যাপক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে তাইগ্রের সাধারণ জনগণ। খাদ্য-ওষুধসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের গুরুতর সংকট ও ঘাটতি দেখা দিয়েছে সেখানে। সংঘাত চলার কারনে জাতিসংঘ ও অন্যান্য দাতা সংস্থার ত্রাণ সামগ্রিও সেখানে ঠিকমতো পৌঁছাতে পারছিল না।

তবে ইথিওপিয়ার সরকার যে ‍যুদ্ধবিরতির একটি ঘোষণা দিতে যাচ্ছে, তার আভাস আগেই দিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। রোববার এক বিবৃতিতে তিনি বলেছিলেন, ইথিওপিয়ায় সংঘাত বন্ধের বিষয়ে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।

সূত্র: আল জাজিরা

এসএমডব্লিউ