নারী অধিকার নিয়ে আসলে কোন পথে সৌদি
সৌদি আরবে এখন বড় ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া বইছে। আভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে পরিবর্তনের সাথে সাথে অনেক দেশের সাথে সম্পর্কেও আসছে পরিবর্তন। একদিকে কাতারের সাথে দেশটির সম্পর্কের বরফ গলেছে, তেমনি দেশের ভেতরেও নানা ক্ষেত্রে বাধাবিপত্তি কাটছে।
প্রথাগতভাবেই দেশটির নারীদের ওপর নানা ধরনের বিধিনিষেধ আছে। তাদের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো সাধারণত আসে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের মাধ্যমে। দেশটিতে নারীদের ঘোরাফেরার স্বাধীনতা নেই। তবে সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের হাত ধরে এক্ষেত্রে গত কয়েকবছরে দেশটিতে বেশ কিছু বড় বড় পরিবর্তন এসেছে। তারপরও দেশটিতে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যাচ্ছে যার কারণে ক্রাউন প্রিন্সের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়ছে।
বিজ্ঞাপন
তাহলে কি সৌদির সমাজ পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত না?
পুরুষপ্রধান সৌদিতে নারীদের অবস্থা বা তাদের অবস্থানটা ঠিক কীরকম তা নিয়ে সবসময় মানুষের কৌতুহল আছে। দিন দশেক আগেই দেশটির অতি পরিচিত এক মানবাধিকার কর্মীকে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটানোর অভিযোগে প্রায় ৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
লুইজয়ান আল-হাথলৌল নামের এই মানবাধিকার কর্মী আলোচনায় এসেছিলেন যখন তিনি দেশটিতে নারীদের গাড়িচালানোর অধিকারের বিষয়ে ক্যাম্পেইন চালিয়েছিলেন। তিনি এরইমধ্যে কারাগারে দুই বছরের সাজা কাটিয়েছেন। আল-হাথলৌলের সাম্প্রতিক এই কারাদণ্ডের আদেশের সঙ্গে আলোচনায় উঠে আসছে মোহাম্মদ বিন সালমানের নামও।
মোহাম্মদ বিন সালমান গত কয়েকবছরে এমন বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, বলা হচ্ছে যেগুলো নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তার নেওয়া পদক্ষেপের মধ্যে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি মেলার বিষয়টিও রয়েছে। আর এমন পরিস্থিতিতে লুইজয়ান আল-হাথলৌলকে যে সাজা দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে দিয়ে এ প্রশ্ন উঠছে যে তাহলে কি সৌদি আবার উল্টো পথে হাঁটছে?
লুইজয়ান আল-হাথলৌলের পরিবারের অভিযোগ কারাগারে তাকে নানা ধরনের নির্যাতন করা হয়েছে। তার ভাই বলছেন, তাকে যে সাজা দেওয়া হয়েছে, তার বিরুদ্ধে আপিল করা হবে।
মূলত লুইজয়ান আল-হাথলৌলের চালানো ক্যাম্পেইনের কারণেই সৌদি আরবে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি মিলেছে। তবে এ অনুমতি আসার কয়েক বছর আগে তাকে কয়েক সপ্তাহ জেলে কাটাতে হয়। ২০১৫ সালে বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে এই মানবাধিকারকর্মী বলেছিলেন, তিনি তার জীবদ্দশায় সৌদি আরবে নারীদের পুরুষের সমঅধিকার দেখে যেতে চান।
কিন্তু এর তিনবছর পরই তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। সৌদি আরবের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের দাবি তোলার পরই তাকে কারাগারে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তার দাবি-দাওয়ার মধ্যে ছিল- নারীদের ওপর পুরুষের অভিভাবকত্বের ইতি ঘটানো ও গণমাধ্যমে নারী অধিকার নিয়ে কথা বলার সুযোগ দেওয়া। লুইজয়ান আল-হাথলৌলকে গ্রেফতারের পর বিভিন্ন জায়গা থেকে তাকে মুক্ত করার দাবি উঠতে থাকে।
পরিবারের অভিযোগ, কারাগারে লুইজয়ানকে বিদ্যুতের শক দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। তার ওপর পাঁচ বছরের ভ্রমণনিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। লুইজয়ানের ভাই ওয়ালিদ আল-হাথলৌল বলছেন, তার পরিবারের সমস্যাগুলোও এখন আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে।
ওয়ালিদ বলছেন, তার বোনের বিরুদ্ধে যে মামলাটি দায়ের করা হয়েছে তা মিথ্যা মামলা। এ মামলা ও আদালতের সাথে রাজনীতি জড়িত। লুইজয়ানকে চরমপন্থি বলেও আখ্যায়িত করা হয়েছে।
লুইজয়ান আল-হাথলৌলের কারাদণ্ডের রায়টিকে উদ্বেগজনক মনে করে জাতিসংঘও। যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জাতীয় নিরাপত্তাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিতে যাওয়া জেক সুলিভানও মনে করছেন, এটা ঠিক না। তিনি বলছেন, যেখানেই মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে বাইডেন প্রশাসন তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলবে।
এ কথ্য সত্য যে, সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যাকাণ্ড নিয়ে সৌদির বিতর্কিত ভূমিকার পর দেশটিতে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। তবে এ পরিবর্তনের অর্থ সবার কাছে একরকম নয়। যেমন ওয়ালিদ মনে করেন, এটা হলো এক পা এগিয়ে দশ পা পিছিয়ে যাওয়া। তবে দেশটিতে নারী-পুরুষের সমঅধিকারের লড়াই এখনও আগের মতোই চলছে।
২০২০ সালের নভেম্বরে সৌদি আরব জি-২০ একটি ভার্চুয়াল সম্মেলনের আয়োজক দেশ ছিল। তখন দেশটির তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে লুইজয়ান আল-হাথলৌলের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, তাকে গ্রেফতারের সঙ্গে তার অ্যাকটিভিজমের কোনো সম্পর্ক নেই। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারণে লুইজয়ানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি এমন কিছু গোষ্ঠীর সমর্থন করছেন যা সৌদি আরবের শত্রু। তিনি নারী অধিকার নিয়ে যে কাজ করছেন, তার গ্রেফতার হওয়ার সঙ্গে সেসব কাজের কোনো সম্পর্ক নেই। যদি নারী অধিকার নিয়ে যারা কাজ করছেন তাদের গ্রেফতার করা শুরু হয়, তাহলে সৌদির অর্ধেক নারীকে গ্রেফতার করতে হবে। এটা আসলে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন ছিল।
সৌদি আরবে গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার ও ডেমোক্রেসি ফর দ্য আরব ওয়ার্ল্ড নাওয়ের রিসার্চ ডিরেক্টর আব্দুল্লাহ আলাওধ বলছেন, সৌদিতে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার এটা একটা প্রক্রিয়া হয়ে উঠেছে। সৌদি আরবের বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স ক্ষমতায় আসর পর থেকে আমরা এটা খেয়াল করছি। একদিকে তিনি মুখে সামাজিক পরিবর্তনের কথা বলছেন আবার অন্যদিকে লুইজয়ান আল-হাথলৌলের মতো মানুষকে আটক করে কারাগারে ভরে দিলেন। এরমধ্যে দিয়ে সামাজিক পরিবর্তনের পেছনে লুকিয়ে থাকা তার আসল চেহারা সামনে এলো।
তিনি আরও বলেন, এর আগে ‘মডারেট ইসলামের’ চিন্তাধারা গ্রহণ করার সময়ও একই কাজ করেছিল তারা। তখন বেশ কয়েকজন লিবারেল মুসলমানকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অর্থনৈতিক সংস্কারের সময়ও একই কাজ করা হয়েছিল। বেশ কয়েকজন অর্থনীতিবিদকে গ্রেফতার করা হয় ও তাদের কয়েকবছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
গত কয়েকবছরে সৌদি আরবের নারীদের জন্য কিছু কাজ করা হয়েছে। এর কিছু কৃতিত্ব ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে দিতে হয়; যিনি দেশের সামাজিক ব্যবস্থার আধুনিকীকরণে সামনে থেকে ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু তার সাথে সাথে সমাজে সংস্কারের দাবি তোলা অনেকের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
নারীদের বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ে উল্লেখযোগ্য যেসব পরিবর্তন এসেছে সৌদিতে তার মধ্যে রয়েছে- পরিবারের পুরুষ সদস্য ছাড়া বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি মিলেছে সেখানকার নারীদের, নির্বাচনে লড়তে পারবেন এখন সৌদি নারীরা, পারবেন স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখতে, সেনাবাহিনীতেও যোগ দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন এখন সৌদি নারীরা। শুধু তাই নয় সৌদি নারীরা সাইকেল র্যালিতেও অংশ নিয়েছেন।
ধর্মীয় রীতিনীতি ও সামাজিক সংস্কারের এসব উদ্যোগ সৌদি প্রিন্সের ‘ভিশন ২০৩০’ এর অংশ। এসব সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তেল-নির্ভর অর্থনীতির দেশ সৌদিকে আধুনিক ও উদারবাদী করে গড়ে তুলতে চান মোহাম্মদ বিন সালমান।
নারীদের গাড়ি চালানোর ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৮ সালে তুলে নেওয়া হয়। তবে ওই বছরই এই নারীদের গাড়ি চালানোর দাবি তোলা বেশ কয়েকজনকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়; যার মধ্যে লুইজয়ান আল-হাথলৌলের নামও আছে।
এরপর নারীদের জন্য পারিবারিক ক্ষেত্রে অভিভাবকত্বের বিষয়েও পরিবর্তনের দাবি ওঠে। এ ব্যবস্থার সাথে আসলে একজন নারীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিষয় জড়িত। সৌদির পারিবারিক ব্যবস্থায় নারীদের ওইসব সিদ্ধান্ত তার স্বামী, ভাই, বাবা অথবা ছেলে নেন।
তবে ২০১৯ সালে ২১ বছরের বেশি নারীদের ওপর থেকে এই প্রতিবন্ধকতা তুলে নেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ ২১ বছরের বেশি বয়সী নারীরা এখন তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারেন।
আর এসবেই মধ্যেই লুইজয়ান আল-হাথলৌলের গ্রেফতারের পর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো তার মুক্তির দাবি জানিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ প্রায় সব আন্তর্জাতিক সংগঠনই এ বিষয়ে সৌদির কড়া সমালোচনা করেছে।
এনএফ