উত্তর কোরিয়া অতীতে অনেক মারাত্মক দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হলেও সম্প্রতি দেশটির নেতা কিম জং উন সামনের সময়ে মারাত্মক খাদ্য সংকট হতে পারে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। কঠোর গোপনীয়তার কারণে দেশটি থেকে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া কঠিন। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী এই দেশটির খাদ্য পরিস্থিতি কেমন এবং চলতি এবছর কেন এই পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে?

উত্তর কোরিয়ায় খাদ্য মূল্যের কী অবস্থা?
দেশটিতে খাদ্য সংককেটর সবচেয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে অতিপ্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে। এক কিলোগ্রাম ভুট্টার দাম গত ফেব্রুয়ারিতে হঠাৎ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ১৩৭ ওয়ানে (প্রায় দুই মার্কিন ডলারের সমান)। উত্তর কোরিয়ায় নিজস্ব বিভিন্ন সূত্র হতে তথ্য সংগ্রহকারী ওয়েবসাইট ডেইলি এনকে বিষয়টি সামনে এনেছে।

এশিয়া প্রেস ওয়েবসাইটের খবর অনুযায়ী, এরপর আবারও প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর দাম দ্রুত বাড়তে থাকে জুনের মাঝামাঝি। পাচার করা কিছু ফোনের মাধ্যমে এই ওয়েবসাইটটি উত্তর কোরিয়ার মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।

উত্তর কোরিয়ার মানুষ ভুট্টার চেয়ে ভাত বেশি পছন্দ করে, কিন্তু তারপরও তারা ভুট্টা বেশি খায়, কারণ এটি দামে সস্তা। এদিকে চালের দামও কিন্তু বেড়ে গেছে, রাজধানী পিয়ংইয়ংয়ে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের পর চালের দাম সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। তবে চালের দাম বেশ ওঠানামা করে।

উত্তর কোরিয়া বিষয়ক বিশেষজ্ঞ বেঞ্জামিন সিলবারস্টাইন বলেন, উত্তর কোরিয়ার বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমেই দেশটির অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সবচেয়ে ভালো তথ্য পাওয়া যায়, কারণ উত্তর কোরিয়ার মানুষ বাজারে গিয়ে লেন-দেনের মাধ্যমেই তাদের খাবার এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য কেনে। সরকারি কর্মচারীদের একেবারে ক্ষুদ্র একটি অংশই কেবল রাষ্ট্রের কাছ থেকে খাদ্য সাহায্য পেয়ে থাকে বলে জানান তিনি।

সরকার যে রেশন দেয়, তা আসলে বেশিরভাগ পরিবারের চাহিদা মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়, আর বড় বড় নগরী থেকে যারা দূরে, তাদের জন্য তো এই রেশন মোটেই নির্ভরযোগ্য নয়। এর মানে হচ্ছে, বহু মানুষই তাদের খাদ্য চাহিদা মেটাতে রাস্তার ধারে বসা অবৈধ বাজারের ওপর নির্ভর করে।

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় ফসলের ক্ষতি
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন খাদ্য সংকট হতে পারে বলে দেওয়া হুঁশিয়ারিতে তিনি গত বছর টাইফুন (ঘূর্ণিঝড়) এবং বন্যায় ফসলের ক্ষতির কথা উল্লেখ করেছিলেন। প্যারিস-ভিত্তিক কৃষি পর্যবেক্ষণ সংস্থা জিওগ্লামের হিসেবে, ১৯৮১ সালের পর গত বছরের এপ্রিল হতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে উত্তর কোরিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়েছে।

একের পর এক টাইফুন, আঘাত হেনেছে কোরিয়ান উপদ্বীপে। এরমধ্যে তিনটি টাইফুন উপকূলে আঘাত হেনেছিল গত আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে। উত্তর কোরিয়ায় এই সময়টি ছিল ধান এবং ভুট্টার ফসল তোলার মৌসুম।

জুন মাস নাগাদ খাদ্য দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠতে পারে, কারণ আগের বছরের শরৎকালের ফসল থেকে সরকার যে খাদ্য মজুদ গড়ে তোলে, সেটা ততদিনে প্রায় ফুরিয়ে যায়। বিশেষ করে কোনো বছর যদি ফসল উৎপাদন কমে গেলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

গত বছরের আগস্টের শুরুতে দেশটিতে টাইফুন ‘হাগুপিট’ আঘাত হানে এবং এর ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত বিবরণ রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, বন্যায় ৪০ হাজার হেক্টর (এক লাখ একর) ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়েছে এবং ১৬ হাজার ৬৮০টি ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে। তবে এরপর আরও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানলেও সেগুলোর ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে এড়িয়ে যাওয়া হয়।

উত্তর কোরিয়ায় কয়েক দশক ধরে যেভাবে বনাঞ্চল উজাড় করা হয়েছে, তার ফলে এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি করে হচ্ছে। ১৯৯০ এর দশকে দেশটিতে যখন তীব্র অর্থনৈতিক সংকট চলার সময় জ্বালানির জন্য ব্যাপক হারে বনাঞ্চল ধ্বংস করে গাছ কাটা হয়। এরপর নিয়মিত বৃক্ষরোপণ অভিযান চালানো হলেও, বনাঞ্চল উজাড় অব্যাহত রয়েছে, যা বন্যার ভয়াবহতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ গত মার্চে প্রকাশ করা এক রিপোর্টে বলেছিল, ২০১৯ সালে উত্তর কোরিয়ায় ২৭ হাজার ৫০০ হেক্টর বন উজাড় করা হয়েছে। ২০০১ সাল হতে এপর্যন্ত ধ্বংস করা হয়েছে ২ লাখ ৩৩ হাজার হেক্টর জমির গাছপালা। উত্তর কোরিয়া বিষয়ক একটি ব্লগ থার্টি এইট নর্থের হিসেবে, দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার যদিও কিছুটা উন্নতি ঘটেছে, তারপরও এটি এখনও অনেক অপর্যাপ্ত।

সারের তীব্র সংকট
উত্তর কোরিয়ার কৃষিখাতের যে সমস্যাটির কথা খুব কম জানা যায়, সেটি হচ্ছে সারের সংকট। সেখানে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট সার জোগাড় করার খুবই কঠিন। ২০১৪ সালে কিম জং উন এক চিঠিতে সহজে পাওয়া যায় এমন সারের উৎস খুঁজে বের করতে কৃষিখাতের শীর্ষ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

রাষ্ট্রীয় সংবাদসংস্থা কেসিএনএ’র প্রকাশ করা এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘সব ধরনের গোবর ব্যবহার করুন, যেমন গৃহপালিত পশুর গোবর, মানুষের মল, গোবর সার এবং খাদের তলার মাটি।’

নিকেই এশিয়া গত ফেব্রুয়ারিতে জানিয়েছিল, উত্তর কোরিয়া সার উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। দেশটির একটি প্রধান সার কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছিল প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের অভাবে। আর এই যন্ত্রাংশ যে পাওয়া যাচ্ছিল না, তার জন্য দোষারোপ করা হচ্ছিল কোভিডের কারণে দেশটির প্রধান বাণিজ্য অংশীদার চীনের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে।

নিষেধাজ্ঞার কারণে উত্তর কোরিয়ার বাণিজ্য খুবই সীমিত
উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে যেহেতু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য হয় একেবারেই সীমিত আকারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন থেকে উত্তর কোরিয়ায় মোট রফতানির পরিমাণ ছিল ২৫০ কোটি থেকে ৩৫০ কোটি ডলার। কিন্তু চীনের শুল্ক দফতরের দেওয়া হিসেব অনুযায়ী, গত বছর এই বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি ডলারের নিচে।

উত্তর কোরিয়া এবং চীনের সীমান্তের দুই পাশের যেসব স্যাটেলাইট ছবি পাওয়া যায়, তাতে সীমান্তের দুই দিকে (সিনিইজু এবং ডানডংয়ের কাছে) ২০১৯ সালের তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা অনেক কমে গেছে বলে দেখা যাচ্ছে।

সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, এ থেকে বাণিজ্যের জন্য এই সীমান্ত সম্ভবত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই সংস্থার গবেষকরা ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সীমান্তের কাছে একশোর বেশি গাড়ি দেখেছিলেন, কিন্তু ২০২১ সালের মার্চ মাসে সেখানে ছিল মাত্র ১৫টি গাড়ি।

অবশ্য মার্চ মাসে একইস্থানে আগের তুলনায় অনেক বেশি রেলের বগি দেখা গেছে। এ থেকে পর্যবেক্ষকরা ধারণা করছেন যে আরও বাণিজ্য হয়তো শুরু হবে। তবে উত্তর কোরিয়ার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সীমান্ত খুব শিগগিরই খুলে দেওয়া হবে এমন ইঙ্গিত এখনও পাওয়া যায়নি।

খাদ্য ত্রাণ নিয়ে সমস্যা
সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ায় উত্তর কোরিয়ার খাদ্য ত্রাণ পেতেও সমস্যা হচ্ছে। এই খাদ্য ত্রাণ নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে। উত্তর কোরিয়াকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য দেয় চীন। কিন্তু করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর চীন থেকে উত্তর কোরিয়ায় খাদ্য রফতানি ৮০ শতাংশ কমে গেছে।

জাতিসংঘ বলছে, গত দশকে দাতা দেশগুলো থেকে উত্তর কোরিয়ায় যথেষ্ট ত্রাণ সাহায্য যায়নি। আর বেশিরভাগ আন্তর্জাতিক খাদ্য ত্রাণ সংস্থা এই মূহুর্তে উত্তর কোরিয়ায় কাজ করতে পারছে না, কারণ করোনার কারণে জারি করা বিধিনিষেধ মেনে সেখানে তাদের কাজ করা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচীর (ডব্লিউএফপি) কুন লি বিবিসিকে জানিয়েছেন, মহামারির পর এ পর্যন্ত তাদের সংস্থা উত্তর কোরিয়ায় কোনো গৃহস্থালি খাদ্য জরিপ চালাতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘তবে এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও ২০২০ সালে ডব্লিউএফপি সীমিত কিছু সরবরাহ সেখানে পাঠিয়েছিল এবং প্রায় ৭ লাখ ৩০ হাজার মানুষের কাছে খাদ্য পৌঁছে দিয়েছিল।’

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, উত্তর কোরিয়ার প্রায় দুই থেকে তিন মাসের সরবরাহের পরিমাণ খাদ্য ঘাটতি রয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়, ‘যদি বাণিজ্যিকভাবে আমদানি এবং খাদ্য ত্রাণের মাধ্যমে এই ঘাটতি মেটানো না হয়, তাহলে ২০২১ সালের আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত উত্তর কোরিয়ার মানুষ খুবই কঠিন এক মঙ্গার মুখোমুখি হবে।’

টিএম