সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কৌশলে কি পরিবর্তন আসছে? বিদেশের মাটিতে বিপুল সংখ্যক পশ্চিমা জোটের সৈন্য মোতায়েনের দিন কি শেষ? বিশ বছর পর আফগানিস্তান ছেড়ে যাবার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর সৈন্যদের তাড়াহুড়ো দেখে কারও কারও এটা মনে হতে পারে।

মার্কিন-নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের যে অবশিষ্ট কয়েক হাজার সৈন্য এতোদিন আফগানিস্তানে মোতায়েন ছিল, তারাও চলতি মাসেই বিদায় নিচ্ছে। ইরাকে ব্রিটেন ও অন্য পশ্চিমা দেশগুলোর যে সৈন্যরা এখন আছে - তাদের এখন আর কোনো বড় রকম সরাসরি যুদ্ধের ভূমিকা পালন করতে হচ্ছে না। আফ্রিকার দেশ মালিতে ফ্রান্সের সৈন্যদের সামরিক ভূমিকাও এখন বহুলাংশে কাটছাঁট করার ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের তথাকথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণার ২০ বছর পর এখন কি পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বহুদূরের কোনো দেশের যুদ্ধক্ষেত্রে বড় সংখ্যায় সৈন্য মোতায়েনের দিন শেষ হয়ে আসছে? হয়তো এখনও কথাটা পুরোপুরি সঠিক তা বলা যাবে না। এখনও সাহেল অঞ্চলে জিহাদিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বেশ বড় সংখ্যায় পশ্চিমা সৈন্য মোতায়েন রয়েছে।

কিন্তু এসব মিশন ভবিষ্যতে কীভাবে চালানো হবে সে ব্যাপারে একটা বৈপ্লবিক নতুন চিন্তাভাবনা এখন শুরু হয়ে গেছে। পশ্চিমা দেশগুলো দেখছে যে, বড় আকারের দীর্ঘমেয়াদি সেনা মোতায়েনের জন্য আর্থিকভাবে যেমন - তেমনি প্রাণহানি ও রক্তপাতের দিক থেকে এবং দেশের ভেতরে রাজনৈতিক দিক থেকেও অনেক বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে।

যেমন, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতির পেছনে খরচ হয়েছে এক ট্রিলিয়ন বা এক লাখ কোটি ডলারেরও বেশি। তারপরে আছে প্রাণহানি, হাজার হাজার মৃত্যু। আফগানিস্তানে শুধু পশ্চিমা সৈন্যরাই নয়, বিদ্রোহী, আফগান বাহিনী এবং সর্বোপরি আফগান বেসামরিক মানুষও নিহত হয়েছে।

আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি বিদেশী সৈন্য ছিল ২০১০ সালে- ১ লাখেরও বেশি। তারপরেও ২০ বছর মোতায়েন থাকার পর যখন অবশিষ্ট কয়েক হাজার বিদেশী সৈন্য বিদায় নিচ্ছে, তখন তালেবান ক্রমাগত আরও বেশি করে ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিচ্ছে।

‘একিলিসের গোড়ালি’
প্রকৃতপক্ষে যেকোন বিদ্রোহী তৎপরতা দমনের জন্য যত বেশি সংখ্যায় এবং যত বেশি সময়ের জন্য সেনাবাহিনী ব্যবহার করা হয় - ততই তাদের ভেতরে তৈরি হয় নানারকম ‘একিলিসের গোড়ালি’ অর্থাৎ ‘দুর্বল জায়গা’। এর মধ্যে একটি হচ্ছে নিহতের সংখ্যা। বিদেশে যতই সৈন্য নিহত হতে থাকে ততই এসব সামরিক উপস্থিতি জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে ৫৮ হাজারেরও বেশি মার্কিন সেনা নিহত হয়েছিল। আফগানিস্তানে নিহত হয় প্রায় ১৫ হাজার সোভিয়েত সেনা। এই সংখ্যাগুলো এসব অভিযানের অবসান ডেকে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সে তুলনায় ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত মালিতে মাত্র ৫০ জনের কিছু বেশি সৈন্য হারিয়েছে ফ্রান্স। কিন্তু ফ্রান্সের ভেতরে ইতোমধ্যেই তাদের এই মিশন অনেকখানি জনসমর্থন হারিয়ে ফেলেছে।

অর্থনৈতিক ক্ষতি
এরপর আছে আর্থিক ব্যয় - যা প্রায় সব সময়ই হিসেবের বাইরে চলে যায়। সৌদি আরব যখন ২০১৫ সালে ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করেছিল - তারা কখনও ভাবেনি যে ৬ বছর পরও তাদের সেই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। মনে করা হয়, এই যুদ্ধের খরচ বাবদ সৌদি রাজকোষ থেকে এর মধ্যেই ১০ হাজার কোটি ডলার বেরিয়ে গেছে।

মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগও একটি সামরিক অভিযানক পথভ্রষ্ট করে ফেলতে পারে। আফগানিস্তানে বিয়ের পার্টির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা, ইয়েমেনে বেসামরিক মানুষের ওপর সৌদি বিমান হামলা, সংযুক্ত আরব আমিরাতের মিত্রদের ইয়েমেনের ভেতরে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ এ ধরনের সব ঘটনাই অভিযুক্ত দেশের ভাবমূর্তি বা সুনামের হানি ঘটিয়েছে।

ইউএই-র ক্ষেত্রে যা হয়েছিল তা হলো: শিপিং কন্টেইনারের ভেতরে তালাবন্ধ অবস্থায় থাকা বন্দীদের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যাবার ঘটনাটি এত গুরুতর প্রভাব ফেলে যে দেশটিকে ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিতে হয়। তারপরে এমন সম্ভাবনাও আছে যে স্বাগতিক দেশের সরকারকে হয়তো একটি বৈরী শক্তির সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হতে পারে।

যেমন মালি থেকে পাওয়া খবরে বলা হচ্ছে, সেখানকার সরকার জিহাদিদের সাথে এক গোপন আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে এবং তা এমন পর্যায়ে গেছে যে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ হুমকি দিয়েছেন, তিনি দেশটি থেকে সব ফরাসি সৈন্যকে প্রত্যাহার করে নেবেন।

ইরাকের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ সামরিক কর্নেল জেমস কানলিফ বলছেন, ‘ইরাকে শিয়া মিলিশিয়াদের ওপরে ইরানের প্রভাবের বিষয়ে এখনও ব্যাপক উদ্বেগ রয়েছে।’

আফগানিস্তানে ২০০১ সালে তালেবান ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। কিন্তু তারা এখন ক্ষমতায় ফিরে আসবে বলে মনে করা হচ্ছে। পশ্চিমা নিরাপত্তা কর্মকর্তারা বলেন, তালেবান যদি আফগান সরকারের একটি অংশীদার হয়, তাহলে সব রকমের গোয়েন্দা সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যাবে।

কোনো সহজ উত্তর নেই
ব্যর্থ রাষ্ট্র এবং বিপজ্জনক একনায়করা যে ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে তার কোনো সহজ সমাধান নেই। যদি বিদেশের মাটিতে এ ধরনের বড় আকারের সামরিক বাহিনী মোতায়েনের বিপক্ষেই মত তৈরি হয়ে থাকে, তাহলে তার শূন্যস্থান পূরণ করা হবে কী দিয়ে? এর একটা আভাস পাওয়া যায় গত ২ জুন যুক্তরাজ্যের চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল স্যার মার্ক কার্লটন স্মিথের দেওয়া এক বক্তৃতায়।

রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটে দেওয়া ওই বক্তৃতায় তিনি বলেন, এ যুগের সেনাবাহিনী হবে অনেক বেশি নেটওয়ার্ক-সমৃদ্ধ, অপেক্ষাকৃত অভিযাত্রী-সুলভ এবং অনেক বেশি দ্রুত মোতায়েনযোগ্য। তার মতে, ‘তারা সংযুক্ত থাকবে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে, সৈনিকের সঙ্গে যোগাযোগ হবে উপগ্রহের মাধ্যমে এবং স্পেশাল অপারেশনস ব্রিগেডের ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা হবে।’

‘যুদ্ধক্ষেত্রের মাটিতে সৈন্যের সংখ্যা থাকবে কম’
যদি ‘বুটস অন দ্য গ্রাউণ্ড’ কম হয়, অর্থাৎ প্রকৃত যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যের সংখ্যা কম হয় - তাহলে তার অর্থ হলো একেবার সর্বাধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তির ওপর নির্ভরতা বেড়ে যাবে। এর সঙ্গে যুক্ত হবে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তাও। সাম্প্রতিক কিছু যুদ্ধ থেকে এমন কিছু প্রবণতা বেরিয়ে এসেছে যা কৌশলগত অগ্রাধিকারের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক রকমের নতুন সব চিন্তাভাবনার জন্ম দিয়েছে।

কিছুদিন আগে ককেশাস অঞ্চলে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের সংক্ষিপ্ত যুদ্ধের সময় দেখা গেল, আর্মেনিয়ার ট্যাংকগুলোকে ধ্বংস করা হচ্ছে সস্তা, মনুষ্যবিহীন ও সশস্ত্র ড্রোন দিয়ে। আজারবাইজানের বাহিনীকে এসব ড্রোন সরবরাহ করেছিল তুরস্ক। এগুলোকে সহজেই উড়িয়ে নিয়ে টার্গেটে আঘাত করা হয়েছে, কিন্তু ড্রোনগুলো যে পরিচালনা করছে - তাকে প্রায় কোনো ঝুঁকির মুখে পড়তে হয়নি।

ভাড়াটে সৈন্যরা ফিরে আসছে?
আফ্রিকায় এক সময় যুদ্ধে ভাড়াটে সৈন্য ব্যবহৃত হয়েছিল, কিন্তু মনে করা হতো এটা এখন অতীতের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। কিন্তু লিবিয়া থেকে পশ্চিম আফ্রিকা এবং মোজাম্বিকেও দেখা যাচ্ছে, রাশিয়ার রহস্যময় ওয়াগনার গ্রুপ সশস্ত্র সংঘাতের এলাকাগুলোতে খুব কম বিধিনিষেধের মধ্যে কাজ করে চলেছে। এ ব্যাপারটি মস্কোর জন্য প্রয়োজনে অস্বীকার করারও সুযোগ তৈরি করেছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো ড. শন ম্যাকফেট বলছেন, ‘রাষ্ট্রকেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা এখন পথ ছেড়ে দিচ্ছে রাষ্ট্র-বিহীন একধরনের যুদ্ধের জন্য।’

অবশ্য এগুলো থেকে এমন অর্থ করা ঠিক হবে না যে, বিদেশে সামরিক মিশনের যুগ একেবারে শেষ হয়ে গেছে। মালি এবং সাহেল অঞ্চলে ফ্রান্স হয়তো তাদের একক অপারেশন বন্ধ করে দিচ্ছে এবং হাজার হাজার সৈন্য দেশে ফিরিয়ে আনছে। কিন্তু সেখানে জাতিসংঘের মিশন চলছে এবং ফরাসিরা সেখানে কিছু সৈন্য মোতায়েন রাখবে - যারা একটি বহুজাতিক সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযানের সঙ্গে জড়িত হবে।

ইরাকে স্থানীয় বিদ্রোহী-দমনকারী বাহিনীকে প্রশিক্ষণ এবং কারিগরি সহায়তা দেওয়া অব্যাহত রাখবে ন্যাটো মিশন। তবে আফগানিস্তানে পশ্চিমা সামরিক উপস্থিতির অবসান হচ্ছে। এর অবসান হচ্ছে ঠিক এমন এক সময়, যখন তালেবান, আল-কায়েদা ও ইসলামিক স্টেট -এই তিনটির এক মিলিত হুমকি মোকাবিলার জন্য তাদের উপস্থিতি হয়তো সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল।

টিএম