ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন চলছে। পারমাণবিক প্রকল্পকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক উত্তেজনা চলমান থাকার কারণে এই নির্বাচন নিয়ে দেশটির অভ্যন্তরীণ সমাজের পাশাপাশি আগ্রহ তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। 

যদিও দেশের জনগণকে ব্যাপকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন ইরানের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খামেনি; তবে দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলোর বরাত দিয়ে পাশ্চাত্য গণমাধ্যমগুলো তাদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলেছে, নির্বাচনকে ঘিরে এক ধরনের হতাশায় ভুগছেন ইরানের গণতন্ত্রপন্থি ভোটাররা।

তাদের হতাশার মূল কারণ নির্বাচনে এগিয়ে থাকা প্রার্থী ইব্রাহিম রাইসি, যার পুরো নাম ইব্রাহিম রাইসুল সাদাতি। খামেনির আর্শীবাদপুষ্ট এই প্রার্থীর অতি রক্ষণশীল মনোভাবেই হতাশ ইরানে ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল সরকারের বিরোধীরা।

কে এই রাইসি

ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান ৬০ বছর বয়সী রাইসি বর্তমানে দেশটির ক্ষমতাসীন সরকারের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম। এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচনী দৌড়ে শামিল হয়েছেন তিনি। এর আগে ২০১৭ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও একবার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন, সেবার হাসান রুহানির কাছে পরাজয় হয়েছিল তার।

ইরানের সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক নেতা খামেনি এবং রাইসির জন্ম একই স্থানে, দেশটির উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় শহর মাশহাদে। খামেনির মতো না হলেও দেশটির সংখ্যাগুরু শিয়া সম্প্রদায়ের কট্টরপন্থিমহলে তার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপক।

খামেনির মতো রাইসিরও দাবি, ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহম্মদ (সঃ)-এর রক্তসম্পর্কিত উত্তরাধিকার রয়েছে তার। এ কারণে সবসময় কালো রংয়ের পাগড়ি পরেন তিনি।

তবে ইরানের গণতন্ত্রপন্থি বলয়ে তার জনপ্রিয়তা বেশ কম। কারণ, আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় দেশটিতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন গণতন্ত্রপন্থিরা, যারা ক্ষমতাসীন ইসলামী কট্টরপন্থি সরকারের বিরোধী। যুদ্ধ শেষে রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতার কারণে শত শত গণতন্ত্রপন্থিকে গ্রেফতার করা হয় এবং তেহরানের রেভ্যুলুশনারি আদালত সংক্ষিপ্ত বিচারকাজের পরই তাদের অধিকাংশকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেয়। সে সময় রেভ্যুলুশনারি আদালতের প্রধান বিচারক ছিলেন রাইসি।

ওই বিচার প্রক্রিয়ার পরই খামেনির আস্থাভাজন হিসেবে হিসেবে উত্থান ঘটে তার। ২০১৯ সালে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্থা আস্তান কুদস রাজাভি ফাউন্ডেশনের প্রধান হিসেবে রাইসিকে নিয়োগ দেন খামেনি। ইরানের শিয়া মুসলিমদের কাছে পবিত্র তীর্থ বলে বিবেচিত ইমাম রেজার মাজারের রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি দাতব্য কার্যক্রম ও দেশের অধিকাংশ কোম্পানি পরিচালনাও করে থাকে এই ফাউন্ডেশন।

তিন বছর মোটামুটি সফলভাবে আস্তান কুদস রাজাভি ফাউন্ডেশনের নেতৃত্ব দেওয়ার পর ২০১৯ সালে তাকে বিচার বিভাগের প্রধান পদে নিয়োগ দেন খামেনি। এ পদে থাকার সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নেওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে জনপ্রিয়তা কিছুটা বাড়ে তার।

রাইসির রাজনৈতিক দর্শন

নিজেকে ‘দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অভিজাতদের’ ঘোর বিরোধী হিসেবে জাহির করা রাইসি রাজনৈতিক দিক থেকে শিয়া ইসলামী কট্টরপন্থার সমর্থক। দেশের গণতন্ত্রপন্থিদের পাশাপাশি  তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য দেশগুলোরও কঠোর সমালোচক; তবে সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের অর্থনীতি প্রায় পঙ্গু হয়ে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের বিষয়ে সুর নরম করেছেন তিনি।

দেশের গণতন্ত্রপন্থিদের মতে, যদিও তিনি দুর্নীতি ও অভিজাতদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইরানের বর্তমান যে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ প্রশাসন, তা গঠনে তার ভূমিকা আছে এবং তিনি নিজেও এই প্রশাসনেরই অংশ।    

ইরানের রাজনীতি ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ আলী রেজা ইশরাঘি দেশটির সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রসঙ্গে ‘ফরেন রিলেশনস’ সাময়িকীতে লিখেছেন, ‘এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ইরানের রাজনীতিতে নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান আরও শক্তিশালী হবে এবং দেশটির গণতন্ত্রপন্থিদের সঙ্গে রক্ষণশীলদের দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পাবে।’

সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট

এসএমডব্লিউ