বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া জাতিগত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যক্তিগত তথ্য অনৈতিকভাবে সংগ্রহ করার পর মিয়ানমারের কাছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর পাঠিয়ে দেয় বলে অভিযোগ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সম্ভাব্য প্রত্যাবাসনের যোগ্যতা যাচাই করতে মিয়ানমারের কাছে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন তথ্য ইউএনএইচসিআর পাঠিয়েছে বলে মঙ্গলবার নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক এই মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে।

এইচআরডব্লিউ বলছে, তথ্য পাঠানোর এই প্রক্রিয়ায় সংস্থাটি তাদের প্রয়োজনীয় নীতিমালা অনুযায়ী পূর্ণাঙ্গ তথ্য প্রভাবের বিষয়টি মূল্যায়ন করেনি। এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে তথ্য শেয়ারের বিষয়ে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা সেই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সম্মতিও নেয়নি ইউএনএইচসিআর। রোহিঙ্গাদের অনুমতি ছাড়াই মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার তথ্য পাঠানোর বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশে শিবিরে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গার নাম নিবন্ধন করেছে এবং বাংলাদেশ সরকার তাদের পরিচয়পত্র দিয়েছে; প্রয়োজনীয় সহায়তা এবং সেবা পাওয়ার জন্য এই পরিচয়পত্রের দরকার হয়। সেই সময় সম্ভাব্য প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমার সরকারের কাছে শরণার্থী সম্পর্কিত তথ্য জমা দিতে অ্যানালগ বা স্থির ছবি, বৃদ্ধা আঙ্গুলের ছাপ এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে বাংলাদেশ।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সঙ্কট ও সংঘাত বিষয়ক পরিচালক লামা ফাকিহ বলেছেন, ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি সংস্থাটির নিজস্ব নীতিমালার সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং এর মাধ্যমে শরণার্থীদের আরও ঝুঁকির মুখোমুখি করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় এবং অবহিতমূলক সম্মতি পাওয়ার পরই কেবল তাদের নিজ দেশের সঙ্গে তথ্য-উপাত্ত শেয়ার করতে পারে ইউএনএইচসিআর।
 

২০১৬ সাল থেকে মিয়ানমার ৮ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে বহিষ্কার করেছে অথবা মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যা থেকে বাঁচতে এই রোহিঙ্গারা সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে পালিয়েছেন। মিয়ানমার সরকার এখনও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে জাতিগত নিপীড়ন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ অব্যাহত রেখেছে।

কক্সবাজারে ইউএনএইচসিআরের নিবন্ধনের অভিজ্ঞতার বিষয়ে জানতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ২৪ রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নিয়েছে। এছাড়া ২০ জন মানবিক সহায়তা কর্মী, বিশ্লেষক, স্থানীয় মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছে এইচআরডব্লিউ; যারা রোহিঙ্গা নিবন্ধন কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন অথবা পর্যবেক্ষণ করেছেন।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই বিষয় গত ফেব্রুয়ারি এবং এপ্রিলে ইউএনএইচসিআরের কাছে দুই দফায় বিস্তারিত প্রশ্ন ও গবেষণার ফল পাঠিয়ে দেয়। ইউএনএইচসিআর গত ১০ মে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রশ্ন ও গবেষণার ফলের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া জানায়। 

এতে ইউএনএইচসিআর কোনও ধরনের ভুল কিংবা নীতি লঙ্ঘনের বিষয়টি অস্বীকার করে জানায়, তারা তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রমের সকল উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছিল এবং রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে সম্মতিও নিয়েছিল। সংস্থাটি বলছে, তথ্য সংগ্রহের প্রচেষ্টার লক্ষ্য ছিল শরণার্থীদের জন্য দীর্ঘকালীন সমাধান খুঁজে বের করা এবং কোনও রোহিঙ্গা যাতে ঝুঁকির মধ্যে না পড়ে সেটি নিশ্চিত করা।

২০১৮ সালে বাংলাদেশ সরকার ইউএনএইচসিআরের সাথে একটি যৌথ নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করে। সরকার শরণার্থীদের জন্য– ‌‘স্মার্ট কার্ড’ নামে পরিচিত একটি পরিচয়পত্র দেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছিল। এই কার্ডধারীরা ত্রাণ সহায়তা এবং অন্যান্য সেবা পেয়ে থাকেন। সরকার প্রত্যাবাসন যোগ্যতার মূল্যায়নে মিয়ানমারে জমা দেওয়ার জন্য ইউএনএইচসিআরের সংগৃহীত রোহিঙ্গাদের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছিল। ইউএনএইচসিআর সেই সময় জানায়, এটি শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের অধিকার রক্ষায় সহায়তা করবে।

গত জানুয়ারিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সঙ্গে এক বৈঠকে ইউএনএইচসিআর জানায়, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন যোগ্যতার মূল্যায়নের জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তাদের তথ্য মিয়ানমারের কাছে শেয়ার করার অনুমতি চেয়েছিলেন। সেই সময় যারা তথ্য শেয়ারে রাজি হননি; তারাও স্মার্ট কার্ড পাবেন বলে কর্মকর্তারা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। নিবন্ধন কার্যক্রমের সময় ইউএনএইচসিআরের কর্মীরা প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে, তথ্য সংগ্রহের সঙ্গে প্রত্যাবাসনের সংশ্লিষ্টতা নেই। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে একটি রোহিঙ্গা কমিউনিটি রেডিও শো-তে এবং একই বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও ইউএনএইচসিআরের কর্মীরা একই ধরনের মন্তব্য করেন।

জোরপূর্বক প্রত্যাবাসনের জন্য সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করা হতে পারে— এমন আশঙ্কায় ওই সময় রোহিঙ্গা শরণার্থীরা কক্সবাজারে আশ্রয় শিবিরগুলোতে বিক্ষোভ করেন। ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ ও মিয়ানমারের সাথে শেয়ারের বিষয়ে রোহিঙ্গারা অনুমতি দিয়েছিলেন বলে জানুয়ারির বৈঠকে ইউএনএইচসিআর জানালেও হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভিন্ন কথা বলছেন রোহিঙ্গারা।

সাক্ষাৎকার দেওয়া ২৪ জনের মধ্যে একজন ছাড়া সবাই বলেছেন, ‘ইউএনএইচসিআর কর্মীরা তাদের বলেছিলেন যে, ত্রাণ সহায়তার জন্য স্মার্ট কার্ড পেতে তাদের রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। মিয়ানমারের সাথে তথ্য শেয়ার অথবা প্রত্যাবাসন যোগ্যতার মূল্যায়নের সঙ্গে এর কোনও সংশ্লিষ্ট আছে কি-না সে বিষয়ে ইউএনএইচসিআরের কর্মীরা কিছু জানাননি।’

ইউএনএইচসিআরকে যে ২৪ রোহিঙ্গা সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন তাদের তিনজন হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন, তথ্য দেওয়ার পরে ইউএনএইচসিআরের কর্মীরা জানান এই তথ্য প্রত্যাবাসনের কাজে ব্যবহার করা হতে পারে।

তবে একজন বলেছেন, তিনি নিবন্ধন কেন্দ্র ছেড়ে যাওয়ার পর মিয়ানমারের সঙ্গে তথ্য শেয়ারের একটি ঘর রিসিপ্ট কপিতে দেখতে পেয়েছেন। যেখানে শুধুমাত্র ইংরেজিতে হ্যাঁ অথবা না সূচক লেখা ছিল। এই ঘরটিতে সবাই হ্যাঁ দিয়েছেন। তবে এই হ্যাঁ-না সম্মতির ব্যাপারে ইউএনএইচসিআরের কর্মীরা কাউকে কখনও জিজ্ঞাসা করেননি। ইউএনএইচসিআর যে তিনজন ইংরেজি জানা রোহিঙ্গার সাক্ষাৎকার নিয়েছে; তিনি তাদের একজন।

নিবন্ধনের পর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দেওয়া ইউএনএইচসিআরের ইংরেজিতে ছাপানো রিসিপ্ট দেখতে পেয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এতে দেখা যায়, রিসিপ্টের একটি ঘরে তথ্যদাতারা মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে তথ্য শেয়ার করতে চান কি-না লেখা রয়েছে। ইংরেজিতে লেখা এই প্রশ্নের পাশে দুটি ঘরে ‘হ্যাঁ’ এবং ‌‘না’ অপশন রয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২১ জন শরণার্থীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিল; যাদের নাম প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের যাচাই করা তালিকায় ছিল। ২০১৯ সালে প্রত্যাবাসন যোগ্যতা মূল্যায়নের পর যে তালিকা তৈরি করা হয়েছিল; সেখানে এই ২১ জনের মধ্যে ১২ জনের নাম পাওয়া যায়। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে প্রত্যাবাসনের ওই তালিকা প্রস্তুত করা করা হয়েছিল।

সূত্র: এইচআরডব্লিউ ডট ওআরজি।

এসএস