দীর্ঘ ১২ বছর পর ইসরায়েলে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হয়েছে। রোববার (১৩ জুন) কথিত ‘কিং অব ইসরায়েল (ইসরায়েলের সম্রাট)’ বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ক্ষমতা হারিয়েছেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন আরেক কট্টর ইহুদি জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক নেতা নাফতালি বেনেট।

ডান-বাম এবং মধ্যপন্থী সাতটি দলের সমন্বয়ে গঠিত নতুন একটি জোট সরকার রোববার বিকেলে ৬০-৫৯ ভোটে ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটের অনুমোদন পেয়েছে। প্রায় চার ঘণ্টা ধরে এ অধিবেশন চলে।

কোয়ালিশন শরীকদের মধ্যে শুক্রবার সই হওয়া চুক্তি অনুযায়ী আগামী দুই বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকবেন কট্টর জাতীয়তাবাদী দল ইয়ামিনার নেতা নাফতালি বেনেট। তারপর তাকে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে মধ্যপন্থী রাজনীতিক ইয়ার লাপিদের হাতে, যিনি নতুন এই জোট গঠনের মূল কারিগর ছিলেন।

এদিকে বেনেট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। অন্যদিকে দীর্ঘ ১২ বছর ধরে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা নেতানিয়াহু এখন হবেন বিরোধীদলীয় নেতা।

ইসরায়েলের ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর এখন দু’টি প্রশ্ন সামনে চলে আসছে - নানা মত ও পথের সমন্বয়ে এই জোট সরকার আদৌ কতদিন টিকবে এবং ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে নতুন এই সরকারের অবস্থান কী হবে?

কে এই নাফতালি বেনেট
নাফতালি বেনেটের রাজনৈতিক আদর্শ, তার বিশ্বাস, ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে তার অতীতের বক্তব্য-বিবৃতি বিবেচনা করলে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আশাবাদী হওয়ার কোনো কারণ আপাতদৃষ্টিতে নেই।

৪৯ বছর বয়সী নাফতালি বেনেট একসময় নেতানিয়াহুর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ২০০৬ সাল থেকে দু’বছর তিনি নেতানিয়াহুর চিফ অব স্টাফ হিসাবে কাজ করেছেন। ২০০৮ সালে অবশ্য তার সঙ্গে নেতানিয়াহুর মনোমালিন্য তৈরি হয় এবং লিকুদ পার্টি থেকে বেরিয়ে তিনি কট্টর ইহুদি দল ‘জিউয়িশ হোম’ পার্টিতে যোগ দেন এবং ২০১৩ সালে প্রথম এমপি হিসাবে নির্বাচিত হন।

নিজের কট্টর ডানপন্থী আদর্শ নিয়ে তার কোনো রাখঢাক নেই। বিভিন্ন সময় বড়াই করে তিনি বলেছেন নেতানিয়াহুর চেয়েও তিনি বেশি ডানপন্থী। অতি ধার্মিক ইহুদিদের মতো অধিকাংশ সময়ে মাথায় কিপা (এক ধরনের টুপি) পরে থাকেন। উদারপন্থী ইহুদিদের সুযোগ পেলেই উপহাস করেন। বলতে গেলে বেনেট ইহুদি জাতীয়তাবাদ এবং জাত্যভিমানের এক প্রতীক।

‘বসতি-স্থাপনকারীদের নেতা’
অধিকৃত পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম এবং সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করা গোলান মালভূমির ওপর ইসরায়েলের স্থায়ী কর্তৃত্ব এবং সার্বভৌমত্ব কায়েমের পক্ষে তিনি। কট্টর ইহুদিদের মতো তিনি বিশ্বাস করেন, ঐতিহাসিকভাবে এসব এলাকা ইসরায়েলের এবং সে কারণে পশ্চিম তীরকে তিনি সবসময় হিব্রু বাইবেলে বর্ণিত ‘জুদেয়া-সামারিয়া’ নামে অভিহিত করেন।

পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণের কট্টর সমর্থক তিনি। একসময় তিনি ইহুদি বসতি-স্থাপনকারীদের সংগঠন ইয়েশা কাউন্সিলের প্রধান ছিলেন। তাকে মানুষ চেনে ‘বসতি-স্থাপনকারীদের নেতা’ হিসাবে।

স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ঘোর বিরোধী তিনি। বিভিন্ন সময় তিনি ফিলিস্তিন সমস্যাকে তিনি ইসরায়েলের ‘পশ্চাৎদেশের ওপর বিষফোঁড়া’ বলে বর্ণনা করেছেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে টিভিতে এক সাক্ষাৎকারে নাফতালি বেনেট বলেছিলেন, ‘যতক্ষণ আমার হাতে কোনো ক্ষমতা এবং নিয়ন্ত্রণ থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ইসরায়েলের এক সেন্টিমিটার জমি আমি ছাড়বো না।’

এমনকি ইসরায়েলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান না থাকলেও ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার পক্ষপাতী তিনি।

বেনেট কি আপোষ করবেন
যে সাতটি দলের কোয়ালিশনে শরিক হিসাবে প্রধানমন্ত্রী হলেন বেনেট সেখানে ইসলামপন্থী একটি আরব দল ছাড়াও মেরেতজের মত বামপন্থী দল রয়েছে যারা পশ্চিম তীরে ইহুদি দখলদারিত্বে ঘোর-বিরোধী।

কীভাবে নাফটালি বেনেটের মত একজন কট্টর ডানপন্থী রাজনীতিক এমন শরীকদের সাথে হাত মেলালেন তা নিয়ে বিস্ময় এখনও কাটেনি। তার দলের ভেতরেও এ নিয়ে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। তার বহু সমর্থক ক্ষুব্ধ। ক্ষমতায় গিয়ে কি বেনেট তার এতোদিনের আদর্শের সাথে আপোষ করবেন? ভিন্ন পথে হাঁটবেন?

জেরুজালেমে সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক হারিন্দার মিশ্র মনে করেন, ক্ষমতায় গিয়ে শরীকদের সাথে আপোষ করা ছাড়া হয়তো বেনেটের কোনো উপায় থাকবে না। তার মতে, ‘পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি হোক বা ইসরায়েলে সমকামীদের অধিকারের প্রশ্ন হোক - যে কোনো ইস্যুতেই কোয়ালিশন শরীকদের মধ্যে মতপার্থক্য তৈরি হবে। কিন্তু সরকার টিকিয়ে রাখতে যে আপোষ করতে হবে, সেটা তারা সবাই অনুধাবন করে।’

মিশ্র বলেন ‘দুটো ভীতির’ কারণে এই কোয়ালিশন হয়তো টিকে থাকতে পারে এবং বেনেটকে অনেক বিষয়ে নমনীয় হতে দেখা যেতে পারে।

‘প্রথম কথা বেনেট এবং শরীকরা জানেন তাদের ভেতর মত-পার্থক্য চরমে গেলে নেতানিয়াহু ক্ষমতায় ফিরে আসবেন। দ্বিতীয়ত, এই শরীকে যোগ দিয়ে বেনেট নিজে বিরাট ঝুঁকি নিয়েছেন। তার সমর্থকরা ক্ষুব্ধ। সুতরাং এই সরকার যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে ইসরায়েলের রাজনীতি থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারেন বেনেট। ফলে সেই ভয়েই তিনি আপোষ করবেন বলে আমার ধারণা। আপোষ তাকে করতেই হবে।’

তবে, পশ্চিম তীরের ইহুদি বসতি এবং ফিলিস্তিনিদের সাথে আলোচনা শুরুর মতো স্পর্শকাতর বিষয়গুলো নতুন সরকার এখন এড়িয়ে চলবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু বেনেট যে আপোষে প্রস্তুত তার কিছুটা ইঙ্গিত ইতোমধ্যেই পাওয়া গেছে।

শুক্রবার কোয়ালিশনের মধ্যে চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার পর নাফতালি বেনেট বলেন, তার সরকার ইসরায়েলের সব নাগরিকের জন্য সমানভাবে কাজ করবে। ধার্মিক, ধর্ম-নিরপেক্ষ, অতি-ধার্মিক, আরব - সবার জন্য সমানভাবে সরকার কাজ করবে। আমার বিশ্বাস আমরা সফল হবো।

ইসরায়েলের ওপেন ইউনিভার্সিটির রাজনীতির অধ্যাপক তামার হারম্যান নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, ‘ইসরায়েলে এমন অনেক নজির রয়েছে যে কট্টরপন্থী রাজনীতিকরা ক্ষমতায় গিয়ে মধ্যপন্থা নিয়েছেন। বেনেট যখন পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি বাড়ানোর পক্ষে কথা বলেছেন, তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না।’

ক্ষমতা থেকে নেতানিয়াহুর প্রস্থান এবং ক্ষমতায় নাফতালি বেনেটের আগমনকে ফিলিস্তিনিরা কীভাবে দেখছে? হারিন্দার মিশ্র বলেন, ফিলিস্তিনিরা এখন মনে করে ইসরায়েলে ক্ষমতার রদবদলে তাদের ভাগ্যের কোনো বদল হবে না।

তবে, আরব-মুসলিম একটি দলের (মনসুর আব্বাসের ইউনাইটেড আরব লিস্ট) সমর্থন পেতে ইসরায়েলে ফিলিস্তিনি আরব নাগরিকের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কিছু সমঝোতা হয়েছে। আরব শহরগুলোতে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং সেই সাথে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের অনুমোদনহীন বাড়ি ভাঙ্গা বন্ধ রাখার চুক্তি হয়েছে।

হারিন্দার মিশ্র বলেন, ‘সাধারণ ফিলিস্তিনিরা মনে করছে নতুন সরকার অন্তত মন্দের ভালো হতে পারে। তাদের জীবনমানের কিছু উন্নতি হয়তো হবে।’

সূত্র: বিবিসি বাংলা

টিএম