সৌদি আরবের অনেক নারী এখন চাকরি করছেন। ধর্মীয় রক্ষণশীলতার কারণে দেশটিতে এতদিন নারীদের চাকরি করতে তেমন দেখা না গেলেও এখন শ্রমবাজারে উল্লেখ্যযোগ্য হারে নারীর সংখ্যা বাড়ছেই। জ্বালানি তেল বেচে রাজকীয় জীবনযাপনের যে আয়েশ দেশটি এতদিন ভোগ করেছে তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই সৌদির রূপান্তরি সমাজে নারীর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সৌদির ডি-ফ্যাক্টো নেতা ক্রাউন প্রিন্স যুবরাজ সালমানও তাই নানা সংস্কার প্রকল্প শুরু করেছেন।

জ্বালানি তেল নির্ভর দেশটির অর্থনীতিতে নানান সংকট তৈরি হওয়ায় ভবিষ্যতে কেমন হবে অর্থনীতি তাই নিয়ে উদ্বিগ্ন মোহাম্মদ বিন সালমানের উদ্যোগেই নেওয়া সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই মূলত নারীরা এখন চাকরির দিকে ঝুঁকছেন। এ জন্য নারীদের জনসম্মুখে যাওয়া ছাড়াও নানা বিষয়ে তাদের জন্য যেসব রক্ষণশীলতার চর্চা এতদিন বিধিনিষেধ আকারে জারি ছিল তাও তুলে নিতে শুরু করেছে সৌদি রাজতন্ত্র। বিশেষ করে নারীদের শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সৌদি এখন মরিয়া।

তেলের পর ভবিষ্যতের অর্থনীতির ভিত্তি গঠনে নতুন করে চাকরির বাজার তৈরি করা হচ্ছে। যেমন মানুষের জীবনযাপনের ব্যয়ও বেড়েছে দেশটিতে। গ্যাস ও বিদ্যুতের ওপর সরকার যে ভর্তুকি দিত সেটিও আর দেওয়া হচ্ছে না। একইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন ফি ও ট্যাক্স এর বোঝা। ভ্যাট বেড়ে এখন ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। সৌদির পরিবারগুলো এই চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। তাইতো সৌদির রক্ষণশীল সমাজ থেকেও নারীদের কাজে পাঠাতে সরকারগৃহীত এই পদক্ষেপের বিরোধিতা আসছে কম। 

বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীকে শ্রমবাজারে অন্তর্ভূক্ত করার কারণে দেশটির সামাজিক ও অর্থনৈতিক খাতেও এক ধরনের পরিবর্তন জোয়ার শুরু হয়েছে। রক্ষণশীলতা থেকে বের হয়ে সমাজের সকল স্তরে নারীদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটতে শুরু করেছে। নারীদের স্বনির্ভর হওয়ার সংখ্যাটাও বাড়ছে। এতে করে অবশ্য কিছু রক্ষণশীল সৌদির মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তারা নারীদের ঘরের বাইরে বের হওয়ার বিরোধী। তবে শুধু অর্থনীতির সংস্কারের জন্য নয় মানবাধিকার নিয়েও আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে সৌদির ওপর। 

ধর্মীয় পুলিশের দ্বারা নারীদেরকে রক্ষণশীল বিষয়গুলো একসময় মেনে চলতে বাধ্য করা হতো। কয়েক বছর আগেও এর মধ্য দিয়ে যেতে হতো সৌদি নারীদের। তবে ধীরে ধীরে সেই অবস্থার অবসান ঘটতে শুরু করেছে। আর এটা শুধু সৌদি আরবের শহুরে অভিজাত শ্রেণির মধ্যে নয় বরং রক্ষণশীল প্রদেশগুলোতেও এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কোনো ধরনের রক্তের কিংবা পারিবারিক সম্পর্ক নেই এমন নারী-পুরুষরা এখন রেস্তোরাঁয় বসতে পারছেন। অনেক অফিসে নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করছে। সঙ্গীতানুষ্ঠানও হচ্ছে। ব্যবসায়িক সম্মেলনের আয়োজনও হচ্ছে। তাতে সৌদি নারীরাও দেশটির প্রতিনিধিত্ব করছেন। 

তবে এখনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার একক ক্ষমতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুরুষের হাতেই রয়ে গেছে। এ সত্ত্বেও তাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। নারীর অবস্থান শক্ত হচ্ছে। সৌদি শ্রম বিষয়ক সংস্থা যে পরিসংখ্যান দিচ্ছে তাতেও দেখা যাচ্ছে যে, ২০১৬ সালে যেখানে দেশটির মোট কর্মীবাহিনীর মধ্যে ১৯ শতাংশ ছিল নারী, সেখানে ২০২০ সালে তা নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে ৩৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। দিন দিন এই সংখ্যাটা আরও বাড়ছে; যা ইতিবাচক। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা জয় করে নারীরা স্বতস্ফূর্তভাবে ঘরের বাইরে কাজ করছেন। 

দেশটির মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, ‘সৌদি নারীদের ক্ষমতায়নে সরকারের জোরালো প্রতিশ্রুতির কারণে নারীদের মধ্যে এই অবস্থান তৈরি হয়েছে।’ যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের নেওয়া ভিশন-২০৩০ এর অন্যতম লক্ষ্যও এই নারীরা। দেশটির ডি-ফ্যাক্টো এই নেতার নেওয়া সংস্কার কার্যক্রম আলোচিত হয়েছে বিশ্বজুড়ে। তবে তার নেওয়া পদক্ষেপগুলোর মধ্যে কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষী পদক্ষেপের বাস্তবায়ন নিয়ে দেশটির মধ্যে সমালোচনাও রয়েছে।  

এক দশক আগে তার নেওয়া এই মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে নারীরা পুলিশ কর্মকর্তা, ক্যাশিয়ার কিংবা এ রকম আরও নানান পেশায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ পেতে শুরু করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি সমাজে নারীদের নির্ধারিত ধর্মীয় পোশাক পরার যে বিধি জারি ছিল এবং যা মানতে বাধ্য করা হতো তাও তুলে নেওয়া হয়। সৌদি নারীরা এখন জিনসের প্যান্ট পরতে পারেন, খোলা চুলে জনসম্মুখে যেতে পারে। অংশ নিতে অনেক কাজে, যা আগে পারতেন না। সৌদির সমাজও নারীদের এই অবস্থানও মেনে নিতে শুরু করেছে। 

সৌদি আরবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক এই রূপান্তরের শুরু অবশ্য সৌদির প্রয়াত বাদশাহ আবদুল্লাহর সময় থেকে। তিনি জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরতা কমাতে নানা পদক্ষেপ নেন। কিন্তু ২০১৫ সালে যার মৃত্যু হয়। এরপর অবশ্য তার নেওয়া এ সংস্কার কার্যক্রম যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান ক্ষমতায় আসার পর দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। বিগত পাঁচ বছরে সরকার ধর্মীয় পুলিশের ক্ষমতা খর্ব করেছে। নারীদের গাড়ি চালানোর নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে। প্রত্যাহার করা হয়েছে পুরুষ অভিভাবকের অনুমতি নেওয়ার বিষয়টিও।

সৌদির সমাজের রূপান্তর নিয়ে দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক ব্লুমবার্গকে এ প্রসঙ্গে সৌদি আরবে নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কাজ করা একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের চিফ অ্যাডভোকেসি অফিসার সালমা আল-রশিদ বলেন, ‘সরকারের নেওয়া এমন সংস্কার কার্যক্রমে এই বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে যে, কোনো একটি দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে ঘরে বসিয়ে রেখে, নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করে আমরা আর যাইহোক অর্থনৈতিকভাবে দেশের টেকসই উন্নয়ন করতে পারবো না।’

এএস