ভারতীয় পরমাণু সংস্থার বিধি-নিষেধ কেন তুলে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র?
ভারতের পরমাণু শক্তি নিয়ে কাজ করছে এমন অনেক সংস্থার ওপর থেকে বিধি-নিষেধ সরিয়ে নেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দিল্লি সফরে এসে এমন তথ্যই জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান।
সোমবার দিল্লি আইআইটির এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘‘ভারতের শীর্ষস্থানীয় পারমাণবিক সংস্থাগুলো এবং মার্কিন কোম্পানির মধ্যে বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতায় বাধা হয়ে দাঁড়ানো দীর্ঘস্থায়ী বিধিনিষেধগুলো অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ চূড়ান্ত করছে যুক্তরাষ্ট্র।’’
বিজ্ঞাপন
তার মতে, এই পদক্ষেপ ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় অংশীদারিত্বকে দৃঢ় করার ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ; যার জন্য ‘দীর্ঘ অপেক্ষা’ করতে হয়েছে।
১৯৯৮ সালে পোখরানে পরমাণু পরীক্ষার পর বহু দেশের বিরাগভাজন হয় ভারত। নিউক্লিয়ার সেক্টরে ভারতের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় রাশ টানতে বহু পরমাণু সংস্থার ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। পরের দিকে দুই দেশের সম্পর্ক ভালো হওয়ায় বেশ কিছু সংস্থাকে সেই বিধি নিষেধের তালিকা থেকে বাদ দিলেও এখনও অনেক প্রতিষ্ঠান রয়ে গেছে নিষেধাজ্ঞার আওতায়।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমলে দুই দেশের মধ্যে পরমাণু চুক্তি হওয়া সত্ত্বেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বাধা ছিল। সেই সমস্ত বাধা অপসারণের বিষয়ে চূড়ান্ত পদক্ষেপের কথা বলেছেন সুলিভান।
এদিকে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে বিদায় নিতে চলেছেন জো বাইডেন। শিগগিরই শপথ নেবেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার সপ্তাহ দুয়েক আগে ভারত সফরে এলেন সুলিভান। সেকথা মাথায় রেখে তার এই দুই দিনের সফর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতেই ছিল। পাশাপাশি, পরমাণু ক্ষেত্রে সুলিভানের ঘোষণার পর এই সফরকে বিশেষ অর্থবহ বলে মনে করা হচ্ছে।
• কী বলেছেন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা?
সুলিভান বলেছেন, ‘‘সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশ এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং প্রায় ২০ বছর আগে বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতার শক্ত ভিত্তি স্থাপন করলেও আমরা এখনও তা পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারিনি।’’
‘‘বাইডেন প্রশাসন মনে করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে বিকাশ এবং স্বচ্ছ্ব শক্তি তৈরিতে মার্কিন ও ভারতীয় সংস্থাগুলোর অংশীদারিত্বকে মজবুত করতে পরবর্তী বৃহত্তর পদক্ষেপ নেওয়ার সময় আমরা পেরিয়ে এসেছি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের শীর্ষস্থানীয় পারমাণবিক সংস্থা এবং মার্কিন কোম্পানিগুলোর মধ্যে বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতাকে বাধা দেয় এমন দীর্ঘস্থায়ী নিষেধ সরানোর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ চূড়ান্ত করছে। এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিক নথিপত্রের কাজ শিগগিরই সম্পন্ন হবে।’’
এর ফলে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার পথ মসৃণ হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। তার কথায়, ‘‘বেসরকারি ক্ষেত্রে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা এখন ভারতীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করতে পারবেন। দুই দেশের মধ্যে বেসামরিক পরমাণু সহযোগিতাও বাড়বে।’’
ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করও। সুলিভানের ঘোষণাকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।
• কতটা গুরুত্বপূর্ণ এই সফর
বাইডেন প্রশাসনের মেয়াদ শেষ হতে চলেছে। তার আগে সুলিভান ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও তার বৈঠক হয়। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের চিঠি নরেন্দ্র মোদির হাতে তুলে দেন তিনি।
পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘‘ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সুসংহত বৈশ্বিক কৌশলগত অংশীদারিত্ব ইতোমধ্যে প্রযুক্তি, প্রতিরক্ষা, মহাকাশ, জৈব প্রযুক্তি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ একাধিক ক্ষেত্রে নতুন উচ্চতা অতিক্রম করেছে।’’
জনগণের স্বার্থে এবং বিশ্বের মঙ্গলের জন্য এই দুই গণতন্ত্রের মধ্যে সম্পর্কের গতি আরও বৃদ্ধি পাক, সেই আশা প্রকাশ করেন তিনি।
• বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
সুলিভানের এই সফরের বিষয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও লেখক রাজীব ডোগরা বলেন, বিদায়ী সরকারের তরফে কারও অন্য দেশ সফর কিন্তু কোনও প্রচলিত প্রথা নয়, বিশেষত দুই দেশের মধ্যে যখন সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে।
খালিস্তানপন্থি শিখ নেতা গুরপতওয়ান্ত সিং পান্নুর হত্যার ষড়যন্ত্রে ভারতের রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইংয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা, এজেন্টসহ একাধিক ব্যক্তির জড়িত থাকার অভিযোগ তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের এক আদালতে এই নিয়ে মামলাও দায়ের করা হয়। সেই সংক্রান্ত নথি পাঠিয়ে ভারতের কাছে জবাবও জানতে চাওয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তোলা অভিযোগ অস্বীকার করেছে ভারত।
এই বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে টানাপোড়েন দেখা দিয়েছিল। অন্যদিকে, ব্যবসায়ী গৌতম আদানীর বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগকে কেন্দ্র করেও কম জলঘোলা হয়নি। ‘র’ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগের বিষয়ে ইঙ্গিত করে ডোগরা বলেছেন, ‘‘ওই প্রসঙ্গে কিন্তু কোনও উচ্চবাচ্য করা হয়নি এই সফরে। একইসঙ্গে এটাও স্পষ্টভাবে জানানো হয়নি যে নতুন প্রেসিডেন্টের শপথ নেওয়ার ঠিক দুই সপ্তাহ আগে হঠাৎ কেন এই সফরের প্রয়োজন পড়ল। হতে পারে আগামী সময়ে এই সফরের বিষয়ে আরও জানা যাবে।’’
সুলিভানের ভারত সফর নিয়ে মন্তব্য করেছেন আমেরিকান থিংক-ট্যাংক উইলসন সেন্টারের মাইকেল কুগেলম্যানও। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স (সাবেক টুইটারে) তিনি লিখেছেন, ‘‘আইআইটি দিল্লিতে জ্যাক সুলিভান মার্কিন-ভারত নিরাপত্তা ও প্রযুক্তি সম্পর্কের বিশদ মূল্যায়ন করেছেন।’’
‘‘মজার ব্যাপার হলো, তিনি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে প্রযুক্তিগত সাফল্যের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছেন। এছাড়াও বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি ক্ষেত্রে বাকি বাধাগুলো শিগগিরই অপসারণ করা হবে বলে ঘোষণা করেছেন।’’
অন্যদিকে মানব রচনা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড স্টাডিজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক উপমন্যু বসু মনে করেন, এই সফর বিদায়ের আগে সৌজন্য সাক্ষাতের মতো।
তিনি বলেন, ‘‘এটা একটা সমাপ্তি সূচক সফর বলেই হোয়াইট হাউসের পক্ষ থেকে উল্লেখ হয়েছে। ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কিন্তু মোটের ওপর স্থিতিশীল। ট্রাম্পের আগের মেয়াদে আবার ভিন্ন মাত্রা দেখেছে। বাইডেনের সময় স্থিতিশীল ছিল। তাই সমাপ্তি সূচক এই সফর উল্লেখযোগ্য বলেই আমার মনে হয়।’’
• পরমাণু ক্ষেত্র
ভারত ১৯৯৮ সালে রাজস্থানের পোখরানে পরমাণু পরীক্ষা চালায়। এই অভিযানের ফলে একাধিক দেশ থেকে ভারতের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। ভারতীয় পরমাণু ক্ষেত্রে কর্মরত দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের ওপর আরোপ করা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও বিধি-নিষেধের তালিকা থেকে একাধিক ভারতীয় সংস্থাকে সরালেও সেখানে এখনও অনেক প্রতিষ্ঠানই রয়েছে।
অন্যদিকে, ড. মনমোহন সিংয়ের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল ভারতে মার্কিন পারমাণবিক চুল্লি সরবরাহ করা। কিন্তু একাধিক শর্তে দুই দেশ সম্মত না হওয়ায় তা পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। যেমন পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটলে অপারেটর বা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নির্মাতাকে দায়ী করা হবে কি না ইত্যাদি।
সাম্প্রতিক সফরে সেই সমস্ত বাধা দূর করার কথাই বলেছেন সুলিভান।
• কী লাভ
ভারতীয় সংস্থাগুলোর ওপর থেকে বিধি-নিষেধ তুলে নেওয়ার বিষয়ে এখনও বিশদে কিছু জানানো হয়নি। তবে দুই দেশই বলেছে, মার্কিন বিধি নিষেধ না থাকলে বেসামরিক পারমাণবিক ক্ষেত্রে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করতে পারবে।
সেক্ষেত্রে নবায়নযোগ্য শক্তিসহ একাধিক ক্ষেত্রে যেমন বিকাশ ঘটবে, তেমনই ভারতের ক্রমবর্ধমান শক্তির চাহিদা মোকাবিলার ক্ষেত্রেও সুবিধা হবে। পরমাণু দুর্ঘটনার ক্ষতিপূরণের বিষয়ে ভারতের কঠোর আইন রয়েছে। রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই কারণে বিদেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাতাদের সাথে ভারতের চুক্তি প্রভাবিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত ২০২০ সালের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে অতিরিক্ত ২০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল; যার সময়সীমা পিছিয়ে এখন ২০৩০ সাল করা হয়েছে।
২০১৯ সালে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ভারতে ছয়টি মার্কিন পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করতে সম্মত হয়। ২০২২ সালে দুই দেশ সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করার জন্য প্রযুক্তিগত উদ্যোগও চালু করে। সেই দিক থেকে সাম্প্রতিক ঘোষণা বেশ উল্লেখযোগ্য। বিবিসি বাংলা।
এসএস