প্রাসাদে চরম নাটকীয়তা, আসাদের সঙ্গে কী ঘটেছিল শেষ মুহূর্তে?
বিদ্রোহীরা রাজধানী দামেস্ক দখল এবং সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার কয়েক ঘণ্টা আগেই প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সিরিয়া ছেড়ে পালিয়ে যান। গত ৮ ডিসেম্বর দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে নিজের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা থেকে শুরু করে শীর্ষ সামরিক কমান্ডারদেরও কিছু জানাননি তিনি। যা তার সঙ্গে কাজ করা অনেক কর্মকর্তাকে হতবাক করে দেয় বলে সিরিয়ার সাবেক সরকারের অন্তত পাঁচজন কর্মকর্তা ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন।
এমনকি আগের দিন রাতে আসাদ তার ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা বুথাইনা শাবানকে একটি বক্তৃতা প্রস্তুত করতে বলেছিলেন। দামেস্ক বিমানবন্দর থেকে সিরিয়ায় রুশ বিমান ঘাঁটি হামিমিমে পৌঁছানো এবং সেখান থেকে দেশের বাইরে যাওয়ার আগে তার আর সেই বক্তৃতা দেওয়া হয়নি।
বিজ্ঞাপন
নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে সিরিয়ার সাব্কে প্রেসিডেন্টের একজন সহযোগী এএফপিকে বলেছেন, আসাদ তার ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজনদেরও আগে থেকে কিছু না জানিয়েই চলে গেছেন। তিনি বলেন, ‘‘রাশিয়ান ঘাঁটি থেকে একটি বিমান তাকে মস্কো নিয়ে যায়।’’
সিরিয়ান সেনাবাহিনীর ভয়ঙ্কর চতুর্থ ব্রিগেডের কমান্ডের দায়িত্বে ছিলেন আসাদের ভাই মাহের। বিদ্রোহীদের হাত থেকে দামেস্ককে রক্ষার লড়াইয়ের সময় সৈন্যদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে মাহেরের আলাপকালে ঘটনাক্রমে তা শুনে ফেলেন ওই সহযোগী। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ প্রথমে একটি হেলিকপ্টার নিয়ে বাগদাদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
আসাদ সরকারের অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও সূত্রগুলো আসাদের ২৪ বছরের স্বৈরশাসনের একেবারে শেষ মুহূর্তে কী ঘটেছিল, সেই বিষয়ে এএফপির সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের সবাই নিরাপত্তার কারণে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলেছেন।
• নেতাহীন
বিদ্রোহী যোদ্ধারা গত ২৭ নভেম্বর সিরিয়ার উত্তরে সরকারবিরোধী হামলা শুরু করে। সেই সময় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ মস্কোতে ছিলেন। সেখানে তার স্ত্রী আসমার ক্যানসারের চিকিৎসা চলছে।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের এক সাবেক কর্মকর্তা বলেন, দু’দিন পর বাশার আল-আসাদের ছেলে হাফেজ মস্কোর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরেট থিসিসের সনদ নেন। তখন সেই অনুষ্ঠানে পুরো পরিবার উপস্থিত থাকলেও বাশার ছিলেন না। ৩০ নভেম্বর আসাদ যখন মস্কো থেকে ফিরে আসেন, তখন সিরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আলেপ্পো আর তার সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। শেষ পর্যন্ত পরের সপ্তাহে রাজধানীতে পৌঁছানোর আগে বিদ্রোহীরা ধারাবাহিকভাবে হামা এবং হোমস প্রদেশের দখল নিয়ে নেয়।
প্রাসাদের আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, গত রোববার (৮ ডিসেম্বর) দামেস্কের পতনের আগের দিনও তিনি আসাদকে দেখেননি। ‘‘শনিবার আসাদ আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি। আমরা জানতাম তিনি দামেস্কে আছেন। কিন্তু তার সঙ্গে কোনও বৈঠক হয়নি,’’ বলেছেন শীর্ষ ওই কর্মকর্তা।
তিনি বলেন, ‘‘আমরা প্রাসাদে ছিলাম। কোনও বিবৃতি পাওয়া যায়নি। এর ফলে প্রশাসনের উচ্চ ও নিম্ন স্তরে ব্যাপক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল। আসলে আলেপ্পোর পতনের পর থেকে আমরা তাকে দেখিনি, যা অত্যন্ত অদ্ভুত ছিল।’’
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক সেই সময়ে আসাদ সিরিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানদের আশ্বস্ত করার জন্য একটি বৈঠক ডেকেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দেশ শাসন করে আসা এই নেতা বৈঠকে উপস্থিত হননি। প্রাসাদের শীর্ষ ওই কর্মকর্তা বলেছেন, ‘‘আলেপ্পোর পতন আমাদের অবাক করেছে।’’ এরপরই হামার পতন ঘটে বিদ্রোহীদের হাতে।
সিরিয়ার সেনাবাহিনীর একজন কর্নেল এএফপিকে বলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার আমি সকাল সাড়ে ১১টার দিকে হামাতে সৈন্যদের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, শহরটি লকডাউন করা হয়েছে। এমনকি সেখানে একটি ইঁদুরও প্রবেশ করতে পারবে না।’’
তিনি বলেন, দুই ঘণ্টা পর তারা শহরটিতে যুদ্ধ না করার এবং দক্ষিণের হোমসে পুনরায় মোতায়েনের আদেশ পেয়েছিল। রাজধানী দামেস্ক দখলের জন্য কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ ওই শহরে তখন লড়াই জোরদার করেছিল বিদ্রোহীরা।
‘‘সৈন্যরা সেই সময় অসহায় হয়ে পড়েন। তারা পোশাক বদল করে অস্ত্র ছুড়ে বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। তবে কে তাদের আদেশ দিয়েছেন, আমরা তা জানি না।’’ হোমসের গভর্নর স্থানীয় এক সাংবাদিককে বলেন, তিনি সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বলেছিলেন। কিন্তু কোনও সরকারি বাহিনী শহরটি রক্ষা করেনি।
• বিলম্ব
শনিবার সকালের দিকে দামেস্কের ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা কর্মকর্তাদের কেউ একজন আসাদকে একটি বক্তৃতা দেওয়ার ধারণা দেন। প্রাসাদের প্রথম কর্মকর্তা বলেন, ‘‘আমরা যন্ত্রপাতি স্থাপন শুরু করেছি। সবকিছু প্রস্তুত ছিল। পরে আমরা জানতে পেরে অবাক হয়েছিলাম যে, ভাষণটি স্থগিত করা হয়েছে। সম্ভবত রোববার সকালে ভাষণ দেওয়ার জন্য সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল।’’
তার মতে, আসাদের শীর্ষ কর্মকর্তা ও সহযোগীরাও জানতেন না এসব ঘটছে। সিরিয়ার সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে তাদের সংরক্ষণাগারগুলো আগুন দিয়ে ধ্বংস করতে শুরু করেছে।
আসাদের ঘনিষ্ঠ জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, শনিবার স্থানীয় সময় রাত ৯টার দিকে প্রেসিডেন্ট তার রাজনৈতিক উপদেষ্টা বুথাইনা শাবানকে একটি বক্তৃতা প্রস্তুত করতে বলেন। রোববার সকালে প্রচারের আগে এই বক্তৃতা রাজনৈতিক কমিটির কাছে উপস্থাপন করতে বলেছিলেন তিনি।
‘‘রাত ১০টায় বুথাইনা শাবান তাকে আবার কল করেন। কিন্তু তিনি আর ফোন ধরেননি।’’ সেদিন সন্ধ্যায় আসাদের গণমাধ্যমবিষয়ক পরিচালক কামেল সাকর সাংবাদিকদের বলেন, ‘‘প্রেসিডেন্ট খুব শিগগির জাতির উদ্দেশ্যে বিবৃতি দিতে যাচ্ছেন।’’
কিন্তু এর পরপরই সাকরও তার ফোন ধরা বন্ধ করে দেন। একই কাজ করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ আল-রহমাউন। প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কর্মকর্তারা বলেন, ‘‘রোববার বেলা আড়াইটা পর্যন্ত নিজ কার্যালয়ে অবস্থান করেন আসাদ। এর চার ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে বিদ্রোহীরা ঘোষণা দেন, আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন।’’
প্রাসাদের শীর্ষ ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘‘আমরা যেকোনও মুহূর্তে আসাদের কাছ থেকে একটি বিবৃতি বা বার্তা পাওয়ার প্রত্যাশায় ছিলাম। ‘‘আমরা এমন দৃশ্য কল্পনাও করতে পারিনি। প্রেসিডেন্ট তখনও প্রাসাদে আছেন কি না তা আমরা জানতাম না।’’
• সব শেষ
মধ্যরাতের দিকে প্রাসাদের ওই কর্মকর্তাকে বলা হয়, রোববার সকালের জন্য প্রেসিডেন্ট আসাদের একজন ক্যামেরাম্যান দরকার। এই নির্দেশের ফলে আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম যে, তিনি আসলে এখনও প্রাসাদেই আছেন।
কিন্তু রাত ২টার ঠিক আগ মুহূর্তে গোয়েন্দা এক কর্মকর্তা ফোন করে বলেন, ‘‘সকল সরকারি কর্মকর্তা ও বাহিনী তাদের অফিস এবং অবস্থান ছেড়ে চলে যাবেন।’’ তিনি বলেন, আমি হতবাক হয়ে গেলাম। অফিসে তখন আমরা কেবল দু’জন ছিলাম। প্রাসাদ প্রায় খালি ছিল। আমরা একেবারে ধোঁয়াশার মধ্যে পড়ে গেলাম। রাত আড়াইটার দিকে প্রাসাদ ছেড়ে চলে যান তিনি।
দামেস্কের প্রাণকেন্দ্রের উমাইয়াদ স্কয়ারে পৌঁছে দেখেন, সেখান থেকে প্রচুর সৈন্য পালিয়ে যাচ্ছেন। তারা পালিয়ে যাওয়ার জন্য যানবাহনের খোঁজ করছেন। ‘‘তাদের মধ্যে নিরাপত্তা কম্পাউন্ড, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং অন্যান্য নিরাপত্তা শাখার হাজার কর্মকর্তা ছিলেন। পরে আমরা তাদের কাছ থেকে জানতে পেয়েছি যে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, এটা ভয়ঙ্কর দৃশ্য ছিল। দামেস্ক ছেড়ে যাচ্ছে হাজার হাজার গাড়ি। এমনকি গাড়ির সংখ্যার চেয়েও বেশি মানুষ রাস্তায় পায়ে হাঁটছেন। সেই মুহূর্তে আমি বুঝতে পারি, সবকিছু শেষ হয়ে গেছে এবং দামেস্কের পতন হয়েছে।
সূত্র: এএফপি।
এসএস