গত কয়েকদিন ধরে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় হামলা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে

বাশার আল আসাদের শাসনের অবসানের পর ইসরায়েল এখন সিরিয়ার পরবর্তী পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। বিশ্লেষকদের মতে, সিরিয়ার যে পরিবর্তনই হোক না কেন, তা ইসরায়েলের সামনে সুযোগ এবং ঝুঁকি দুটিই এনে দেবে।

গত সপ্তাহান্তে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমান সিরিয়ায় ঢুকে শতাধিক জায়গায় আক্রমণ করেছে বলে মনিটরিং গ্রুপগুলো জানিয়েছে। মূলত সিরিয়ার সামরিক পরিকাঠামোর ওপরই আক্রমণ করেছে ইসরায়েল, যার মধ্যে আছে বিমান ঘাঁটি, রকেট নিয়ে গবেষণা কেন্দ্রগুলো এবং যে সব জায়গায় রাসায়নিক অস্ত্র মজুত রাখা হতো বলে অভিযোগ।

সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের একাধিক জায়গায় হামলা করেছে ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান।

ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সোমবার জেরুজালেমে বলেছেন, “আমরা স্ট্র্যাটেজিক ওয়েপন সিস্টেমের ওপর আঘাত হানতে চেয়েছি। সিরিয়ায় যে রাসায়নিক অস্ত্র আছে বা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট আছে, তা ধ্বংস করতে চেয়েছি। আমরা চাই, এই সব অস্ত্র যেন কট্টরপন্থিদের হাতে না পড়ে।”

এরপর ইসরায়েলের সেনা ইসরায়েল ও সিরিয়ার মধ্যে যে বাফার জোন আছে, সেখানে প্রবেশ করেছে। এই জায়গায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনী প্রহরার কাজে নিযুক্ত। তবে রিপোর্ট বলছে, ইসরায়েলের সেনা দামেস্ক থেকে ৪০ কিলোমিটার দূরের এই বাফার জোন অতিক্রম করে গেছে। সেটা সত্যি হলে, ১৯৭৪ সালের পর ইসরায়েলের সেনা সিরিয়ার এতটা ভেতরে ঢুকল।

মঙ্গলবার বার্তাসংস্থা রয়টার্সকে তিনটি সূত্র জানিয়েছে, ইসরায়েলের বাহিনী দক্ষিণ-পশ্চিম দামেস্ক থেকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার দূরে আছে। তবে ইসরায়েলের সেনা মুখপাত্র এটা অস্বীকার করেছেন।

১৯৬৭ সালে ইসরায়েল গোলান হাইটস দখল করে এবং ১৯৮১ সালে তারা এই অঞ্চল নিজেদের সঙ্গে যুক্ত করে। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বের অধিকাংশ দেশই গোলান হাইটসকে সিরিয়ার অংশ বলে মনে করে এবং তারা মনে করে ইসরায়েল বেআইনিভাবে তা অধিকার করে রেখেছে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ব্যাখ্যা, আসাদের প্রতি অনুগত সিরিয়ার সেনাবাহিনী এই এলাকা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিল। তাই ইসরায়েল এই কাজ করতে বাধ্য হয়। নেতানিয়াহুর দাবি, “ইসরায়েলের সেনা সাময়িকভাবে সেখানে আছে। নতুন কোনো ব্যবস্থা হলেও তারা সরে আসবে।”

জেরুজালেমে এক সাংবাদিক সম্মেলনে নেতানিয়াহু বলেছেন, “আমরা সিরিয়ার নতুন শাসকদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক চাই। কিন্তু ইসরায়েলকে রক্ষা করার জন্য, দেশের সীমান্ত রক্ষা করার জন্য আমরা যা দরকার সেটাই করব।”

তারপর তিনি বলেছেন, গোলান চিরকাল ইসরায়েলের অংশ হয়ে থাকবে।

এদিকে ইসরায়েল সিরিয়ার ভেতরে ঢুকে পড়ায় সমালোচনা ক্রমশ বাড়ছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে, এই ধরনের ঘটনা ১৯৭৪ সালের চুক্তি লঙ্ঘন করেছে।

ইসরায়েলের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্ত নিশ্চয়ই সাময়িক। জর্ডনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এই ঘটনার নিন্দা করেছেন। সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, “ইসরায়েল এভাবে সিরিয়ায় নিরাপত্তা, স্থায়িত্ব, অখণ্ডতার ওপর আঘাত করছে।”

তেল আবিব বিশ্ববিদগ্যালয়ের সিরিয়া বিশেষজ্ঞ ও ভাইস রেক্টর ইয়াল জিসের বলেছেন, “ইসরায়েল যদি সাময়িকভাবে সিরিয়ায় ঢোকে, তাহলে তাদের উদ্দেশ্য কী? তারা সিরিয়ায় রাসায়নিক অস্ত্র কেন ধ্বংস করতে চাইছে, সেটা আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু ইসরায়েলের সেনা সিরিয়ায় ঢুকছে। সিরিয়ার মনোভাব তো এখন ইসরায়েলের বিরোধী নয়, তারা তো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কিছু করেনি, কেউ ইসরায়েলের নামও মুখে আনেনি। তাহলে তারা কেন সেনা পাঠাবে?”

ইসরায়েলের সাংবাদিক নাদাফ ইয়েল লিখেছেন, “ইসরায়েলের হাতে হিজবুল্লাহ প্রবল মার খেয়েছে, ইরানের অবস্থাও ভালো নয়, সিরিয়াতেও তারা পরাজয়ের মুখে পড়েছে। যে গতিতে সিরিয়ায় পুরো ঘটনা ঘটেছে, তাতে ইসরায়েলের গোয়েন্দারাও অবাক হয়ে গেছেন।”

তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞ জিসের বলেছেন, “এই ঘটনা সবাইকে অবাক করে দিয়েছে। বিশেষ করে বাশার আল আসাদ, ইরানের শীর্ষনেতা, রাশিয়া এবং হিজবুল্লাকেও।”

তার মতে, “ইসরায়েলের কাছে ইতিবাচক দিক হলো, আসাদ ছিলেন ইরান ও হিজবুল্লার মধ্যে প্রধান সংযোগকারী। এখন ইরানের কাছে সিরিয়ার ব্যাক আপ থাকল না। এটা একটা নতুন ঘটনা।”

টিএম