গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যে অবনতি ঘটছিল, অনেকটা আকস্মিকভাবেই তা সামনে এলো চলতি সপ্তাহে— এক সময়ের সন্ন্যাসী এবং বর্তমানে বাংলাদেশের সম্মিলিত সনাতন জাগরনী মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তারের পর।

ভারতের মিত্র হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত আগস্ট মাসে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। তারপর থেকে ভারতেই আছেন তিনি।

কিন্তু ভারতে তার এই অবস্থান বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ককে জটিল ও বৈরী করে তুলছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান এবং ৮৪ বছর বয়সী নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহম্মদ ইউনূস গত মাসে এই মর্মে উদ্বেগ জানিয়েছেন, যে ভারতে বসে ফের ক্ষমতায় আসার ষড়যন্ত্র করছেন শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশের হিন্দু ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতন-নিপীড়ন ইস্যুতে ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলোতে অতিরঞ্জিত সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন মুহম্মদ ইউনূস।

তবে অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে টানাপোড়েনের উদ্ভব ঘটেছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে হিন্দু সন্ন্যাসী এবং বাংলাদেশের সম্মিলিত সনাতন জাগরণী মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেপ্তার। ১৭ কোটি মানুষ অধ্যুষিত এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হার শতকরা ১০ শতাংশেরও কম।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় সংস্থা ইসকনের সাবেক সদস্য এবং বর্তমানে চট্টগ্রামের পুণ্ডীরক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে ঔপনিবেশিক আমলের রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় গত সপ্তাহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারের পর যেদিন তাকে চট্টগ্রামের আদালতে তোলা হয়, সেদিন উত্তেজিত জনতার হাতে নিহত হন আইনজীবী সাইফুল ইসলাম।

সাইফুল ইসলামের হত্যাকাণ্ডের জন্য ইসকন সমর্থকদের দায়ী করেছেন অনেকেই, তবে ইসকন এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যাকাণ্ডের পর চট্টগ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে ভয়-ভীতি প্রদর্শণের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এদিকে, এক বিবৃতিতে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের জামিন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ঘটনাকে দুঃখজনক বলে উল্লেখ করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এছাড়া আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হত্যা, মন্দির ভাঙচুর এবং সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের জন্য স্থানীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করা হয়েছে ভারতীয় মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে মুক্তি না দিলে বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্তে বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিজেপি।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। ২০১৮ সালের পর থেকে পুলিশের মাধ্যমেই দেশ পরিচালনা করতেন তিনি। তবে এর পাশাপাশি ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয়েছিলেন হাসিনা।

এটা ঠিক যে তার শাসনমালে কিছু মৌলবাদী শক্তিকে তিনি দমিয়ে রাখতে পেরেছিলেন, যেগুলো তার পলায়নের পর মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, তবে এও সত্য যে তার আমলেও হিন্দুদের ওপর ভয়াবহ কিছু হামলার ঘটনা ঘটেছিল।

গত সপ্তাহে দ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. ইউনূস বাংলাদেশের বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের বিষয়টি স্বীকার করেন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতির কারণ হিসেবে শেখ হাসিনাকে ভারতের সুরক্ষা দেওয়া এবং ভারতের ‘অপপ্রচারের’ কথা উল্লেখ করেন তিনি। তাঁর ভাষ্যে, ভারত থেকে ছড়ানো ‘অপপ্রচারে’ তাঁর সরকারকে চরমপন্থীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার কথা বলে অভিহিত করা হচ্ছে।

ড. ইউনূস বলেন, ‘তিনি (হাসিনা) ভারতে আছেন। তিনি কথা বলে চলছেন। এটা পুরো দেশের জন্য কিছুটা অস্থিতিশীল ব্যাপার এবং আমরা ভারত সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে বলেছি, এটি ন্যায়সংগত নয়। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত কাউকে আপনি জায়গা দিচ্ছেন, আর আপনি তাঁকে কথা বলতে দিচ্ছেন।’

ড. ইউনূস বলেন, ভারত এমন একটি ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করছে যে তাঁর (ড. ইউনূস) অধীন বাংলাদেশ ‘আফগানিস্তানের মতো’ হয়ে উঠছে। এটি দেশের নতুন যাত্রার কঠিন কাজকে আরও কঠিন করে তুলছে।

ড. ইউনূস বলেন, ‘আপনি যদি বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করেন, আপনি নিজেকে অস্থিতিশীল করবেন। কারণ, এই অস্থিতিশীলতার উপাদানগুলো আমাদের চারপাশে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে।’

কিন্তু বিশ্লেষকেরা বলেছেন, শেখ হাসিনা ভিন্নমতকে দমনে যে ঔপনিবেশিক যুগের আইন ব্যবহার করেছিলেন, সেই একই আইনে হিন্দু পুরোহিতকে কারাগারে পাঠিয়ে ড. ইউনূসের সরকার নিজের ভালো করেনি।

শেখ হাসিনার কিছু খারাপ চর্চা, যেমন বিরোধী দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে গণ-মামলা এখনো অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশের হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির উপদেষ্টা নূর খান লিটন বলেন, ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ ও ‘পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র’-এর মতো শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে, যা তাঁরা আগেও দেখেছেন।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সারজিস আলম বাংলাদেশে ইসকন নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি ইসকনকে একটি ‘চরমপন্থী সংগঠন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, “এটি ‘আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’ করার জন্য ভারতের সঙ্গে জোটবদ্ধ।”

ইসকনের বাংলাদেশের নেতারা বলেছেন, সংগঠনটি আইন মেনে চলে। তারা আদালতের বাইরে মুসলিম আইনজীবীর মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করেছেন। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তারা প্রথমে বিবৃতি দিয়েছিলেন। পরে তাঁরা তাঁর থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছেন।

সূত্র : দ্য নিউইয়র্ক টাইমস

এসএমডব্লিউ