করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বিপর্যয়ের মধ্যেই ভারতজুড়ে প্রকোপ শুরু হওয়া মিউকরমাইকোসিস কিংবা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস অর্থাৎ কালো ছত্রাক সংক্রমণকে মহামারি হিসেবে ঘোষণার জন্য দেশের প্রতিটি রাজ্য সরকারে চিঠি পাঠিয়েছে দেশটির কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়

চিঠিতে এই রোগটিকে ‘মহামারি আইন’র অধীনে তালিকাভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এর অর্থ ব্ল্যাক ফাঙ্গাস কিংবা কালো ছত্রাক রোগ সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে রাজ্যগুলোকে। ঠিক যেমনটা হচ্ছে মহামারি করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে।

ভারতের সব সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্ত রোগী বা কারও এই ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে এ সম্পর্কিত তথ্য স্বাস্থ্য দফতর ও পরে ইন্টিগ্রেটেড ডিজিজ সার্ভিল্যান্স প্রজেক্ট (আইডিএসপি) নজরদারি ব্যবস্থাকে জানাতে রাজ্যগুলো বাধ্য থাকবে।

রাজ্যগুলোকে চিঠিটি পাঠিয়েছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব লব আগরওয়াল। সেই চিঠিতে তিনি লিখেছেন যে, ‘মিউকরমাইকোসিসের শনাক্তকরণ, নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত নির্দেশিকা সমস্ত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজগুলোকে অবশ্যই মেনে চলতে হবে’।

চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, রোগটির চিকিৎসার জন্য একাধিক বিভাগের মধ্যে চিকিৎসা পদ্ধতির সমন্বয় চোখের সার্জন, নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ, জেনারেল সার্জন, নিউরোসার্জন, ডেন্টাল ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জনদের সঙ্গে অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধ অ্যামফোটেরিসিন-বি দিয়ে চিকিৎসা জরুরি।

ভারতে করোনা রোগীর কালো ছত্রাকে আক্রান্ত হওয়ার কয়েকটি ঘটনা সামনে এসেছে। কোভিড রোগী ছাড়া অন্যরাও এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগে নাকের উপর কালো ছোপ, দেখতে অসুবিধা হওয়া, বুকে ব্যথা ও শ্বাসকষ্টের মতো সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘এই ছত্রাকের সংক্রমণ কোভিড রোগীদের দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতার কারণ, এটি তাদেরকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।’

মহারাষ্ট্রে ইতোমধ্যে দেড় হাজারের বেশি কালো ছত্রাক সংক্রমিত রোগী চিহ্নিত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে ৯০ জনের। পশ্চিমবঙ্গেও ৫ জনের শরীরে এর উপস্থিতি মিলেছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা কেন্দ্র সরকারকে এই রোগকে মহামারি ঘোষণার পরামর্শ দেয়। 

গতকাল রাজস্থান সরকার কালো ছত্রাককে মহামারি ঘোষণা করেছে। গত মঙ্গলবার হরিয়ানা সরকারও মহামারি ঘোষণা করে। কর্ণাটক, উত্তরাখণ্ড, তেলেঙ্গানা, মধ্যপ্রদেশ, অন্ধ্র প্রদেশ, হরিয়ানা ও বিহারসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কালো ছত্রাকের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।

ভারতে ১৮৯৭ সালের মহামারি আইনের অধীনে কোনো এক রোগ উদ্বেগজনক পর্যায়ে গেলে তাকে মহামারি হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে। আইনটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিশেষ ক্ষমতা দেয় যা রোগের বিস্তার ঠেকাতে নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রয়োজন। 

মিউকোরমাইকোসিস বা কালো ছত্রাক সংক্রমণ কী?  

এটি এক ধরনের গুরুতর ফাঙ্গাল ইনফেকশন (ছত্রাকজনিত সংক্রমণ)। দীর্ঘমেয়াদী (ক্রনিক) কোনো শারীরিক জটিলতা থেকে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়লে এই রোগের সংক্রমণ দেখা দেয় ভারতের নীতি আয়োগ সংস্থার সদস্য (স্বাস্থ্য) ভি কে পাল বলেন, মিউকর নামক একটি ছত্রাক মিউকোরমাইকোসিস সংক্রমণের জন্য দায়ী। সাধারণত আর্দ্র স্থানে এই ছত্রাক জন্মায়।     

কেন কোভিড আক্রান্তরাই এ রোগে সংক্রমিত হচ্ছেন?

কোভিড মহামারির আগে মিউকোরমাইকোসিস খুব একটা বেশি দেখা যেত না। সাধারণত যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, আগে তারাই এতে আক্রান্ত হতেন। কিন্তু মহামারি শুরুর পর থেকে তিনটি ফ্যাক্টর বেড়ে গেছে। এর মধ্যে একটি কোভিড নিজেই, অন্যটি ডায়াবেটিস এবং তৃতীয়টি স্টেরয়েডের অপব্যবহার যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

ডিরেক্টোরেট অব মেডিকেল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের (ডিএমইআর) প্রধান ডা. তাতিরাও লাহানে বলেন, ছত্রাকজনিত রোগটি বাড়ছে কোভিড-১৯ সম্পর্কিত জটিলতা থেকে। এর কারণ স্টেরয়েডের ব্যবহার রক্তে চিনি বা সুগার লেভেল বাড়িয়ে দেয়। তাছাড়া কিছু ওষুধ রোগীর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দমিয়ে রাখে।

এমন পরিস্থিতিতে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাক রোগীকে সহজেই আক্রান্ত করে। যদি এই ছত্রাক মস্তিস্কে পৌঁছে যায় এবং আক্রান্ত করে, তবে তা মারাত্মক রূপ নিতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জীবন বাঁচাতে রোগীর একটি চোখ অপারেশন করে চিরতরে সরিয়ে ফেলতে হয়।

তিনি বলেন, কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীর অন্যান্য জটিলতা থাকলে সহজেই ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

সংক্রমণ পরবর্তী লক্ষণ কী কী ?

মিউকোরমাইকোসিস বা কালো ছত্রাকের সংক্রমণ সাধারণত নাক থেকে উপরের চোয়াল হয়ে মস্তিষ্কে যায়। চোখের নিচে ব্যথা হয়। মুখের একপাশ ফুলে যেতে পারে। মাথাব্যথা, জ্বর, নাকে রক্তজমাট, নাকে (নাসাল ব্রিজ) কালো ঘা দেখা দিতে পারে। কখনও কখনও চোখের দৃষ্টি কমে যায়। একবার যদি এই ছত্রাক মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়, তবে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে।  

কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে কি এ রোগ বেড়েছে?

ডা. লাহানে বলেন, করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময়ও ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণ দেখা গেছে। কিন্তু দ্বিতীয় ঢেউয়ের তুলনায় তা নগণ্য। আগে কোভিড থেকে সেরে ওঠার কয়েক সপ্তাহ পর রোগীরা এ ধরনের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসতেন। কিন্তু এবার কোভিডের চিকিৎসা চলাকালেই রোগীদের মধ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে।

চিকিৎসা

এ রোগের চিকিৎসা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। একদিকে ওষুধের সরবরাহ নেই বললেই চলে, অন্যদিকে ওষুধের দামও অনেক বেশি। ২১ দিনের জন্য রোগীর বিশেষ এক ধরনের ইনজেকশন প্রয়োজন হয়। এ ইনজেকশনের একেকটির দাম ৯ হাজার রুপি। এছাড়া অন্যান্য খরচ তো রয়েছেই।

এএস