শেখ রাশেদ বিন সাঈদ : অন্তহীন পাঠ
দুবাইয়ের শাসক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের ভাইস প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন রাশেদ আল মাকতুম। ১৯৪৯ সালে জন্ম নেওয়া শেখ মোহাম্মদ আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার আগে দুবাই পুলিশের প্রধানের পদে ছিলেন। শেখ রাশেদ বিন সাইদ আল মাকতুমের তৃতীয় পুত্র তিনি। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের জটিল রাজনীতির কেন্দ্রে থাকা আমিরাতের ভাইস-প্রেসিডেন্টও এই শেখ মোহাম্মদ, সঙ্গে দুবাইয়ের শাসকও তিনি। তার বর্তমান ও সাবেক মিলে ছয় জন স্ত্রী রয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। এ ছয় স্ত্রীর ঘরে তার রয়েছে ৩০ জন সন্তান। সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজনীতি, অর্থনীতিসহ ধনকুবের এই প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিজীবনের নানা দিক উঠে এসেছে তার নিজের লেখা ‘কিস্সাতি’ (আমার গল্প) বইটিতে। পঞ্চাশ পর্বে সে গ্রন্থ থেকেই নানা দিক তুলে এনেছেন মুহাম্মাদ শোয়াইব। আজ থাকছে একাদশ পর্ব।
শেখ রাশেদ বিন সাইদ আল মাকতুম। তিনি ছিলেন একজন শাসক। আমার জন্য তিনি শুধু বাবাই নন, ছিলেন একজন শিক্ষক। আর সবার জন্য বাবার সমতূল্য।
বিজ্ঞাপন
ফজরের সালাত দিয়ে তার দিন শুরু হতো। তার কাছ থেকে আমি এই শিক্ষাটি নিয়েছিলাম যে, ফজরের আগেই ঘুম থেকে জাগতে হয়। সেই থেকে আজ অবধি আমি ফজরের সালাত দিয়ে আমার দিন শুরু করি।
তিনি নামাজ পড়ার জন্য ভোর হওয়ার আগেই ঘুম থেকে উঠতেন। তারপর নাস্তা খাওয়ার আগে রাষ্ট্রীয় প্রকল্পগুলো দেখার জন্য কিছু বের হতেন। আমাদের বাড়িতে কাজ করার জন্য বহু মানুষ থাকলেও বাবার নাস্তা সবসময় মা-ই তৈরি করতেন। নাস্তার আগে তিনি প্রাসাদের সামনে বসে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলতেন। প্রকল্পের তদারককারীদের সাথে দেখা করতেন। তিনি যখন তাদের প্রকল্প বাস্তবায়নের উন্নয়নের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতেন তখন আমি খুব উপভোগ করতাম। তিনি জানতে চাইতেন কতটুকু হলো? কতটুকু বাকি আছে ইত্যাদি।
প্রকল্পের তদারককারীরা অবাক হতেন যে প্রকল্পগুলোর বিষয়ে বাবা তাদের চেয়ে ভালো জানতেন। কারণ তিনি ভোর হওয়ার পরে সেগুলো পরিদর্শন করে এসেছেন।
আমার বাবা দিনে কেবলমাত্র একবারই যে সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সঙ্গে দেখা করতেন, ব্যাপারটা মোটেও তেমন না। যাকে আজ ‘অফিসিয়াল ওয়ার্কিং টাইমস’ বলা হয়, কাজের এমন কোনো নির্দিষ্ট সময় তার ছিল না। তিনি সারাদিনই কারো না কারো সাথে দেখা করতেন, কথা বলতেন। তাদের দুঃখ-সুখের কথা শুনতেন। এমনকি মাঝে মধ্যে আসর থেকে মাগরিবের সময়েও তিনি সাক্ষাৎপ্রার্থীদের সাক্ষাৎ দিতেন।
ভোর হওয়ার পরে প্রকল্পগুলোর অবস্থা দেখে এসে বাবা তিনটি সুবিধা পেতেন। প্রথম সুবিধাটি হলো, প্রকল্প-তদারককারীরা যখন প্রকল্পটির ব্যাপারে শাসকের প্রত্যক্ষ আগ্রহ দেখেন, তারা কিছুতেই তাতে অবহেলা দেখাতে পারতেন না। দ্বিতীয়টি হলো, প্রকল্পগুলোতে কাজ আরও জোরদার হবে। কারণ, তাকে প্রতিদিন শেখের সাথে দেখা করতে হবে। তৃতীয় সুবিধা হলো, কোনো ঠিকাদার বা সরকারি কর্মচারি দুবাইয়ের প্রকল্পগুলোতে আর্থিক দুর্নীতি করার সাহস করতেন না। কোনো অর্থ অযথা ব্যয় করা হতো না। কারণ তারা জানতেন, দুবাইয়ের শাসকের পছন্দসই মানের কাজ সম্পন্ন হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো অর্থ প্রদান হবে না।
শাসক নিজেই সমস্ত বিবরণ জানেন ও তদারকি করেন। ঘুরে ঘুরে প্রকল্পগুলো দেখা কর্মচারীদের জন্য একটি বার্তা এবং প্রশাসক ও নেতাদের জন্য একটি শিক্ষা ছিল যে, শেখ রাশেদের দুবাইয়ে দুর্নীতির কোনো স্থান নেই। দুবাইয়ের সুনামের প্রতি সবচেয়ে আগ্রহী ছিলেন তিনি। তিনি বলতেন, আমাদের আসল মূলধন আমাদের খ্যাতি। বিপরীতভাবে, তিনি আইন নিয়ে অবহেলার ব্যাপারে বা প্রযোজ্য বিধি-বিধান ভাঙার ব্যাপারে কোনো চাটুকারিতা শুনতেন না।
‘সাক্লাওয়াই’ নামে তার একটি ঘোড়া ছিল এবং তিনি সেটিকে ছোটকাল থেকে পালতেন। তিনি নিজের হাতে দুধের বোতল থেকে তাকে দুধ খাওয়াতেন। তিনি ব্যক্তিগতভাবে তাকে লালন-পালন ও প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। ঘোড়াটি বড় হলো। শেখ রাশেদের সঙ্গে বেশ ভালো সম্পর্ক হলো। তিনি সন্ধ্যায় তার ঘোড়ায় চড়তেন এবং প্রকল্পগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতেন।
দশম পর্ব : যে মৃত্যুর কথা কখনও ভুলবেন না শেখ মোহাম্মদ
শেখ রাশেদের দুবাই ক্রিকে একটি অফিসও ছিল, যার জানালা দিয়ে তিনি জাহাজের চলাচল এবং পণ্যদ্রব্য পরিবহন পর্যবেক্ষণ করতেন। তিনি জাহাজগুলো চিনতেন। তাদের মালিকদেরও চিনতেন। তারা যে পণ্যগুলো ওঠা-নামা করতো তার পরিমাণও তিনি জানতেন।
নতুন কোনো ব্যবসায়ী যখন তার কাছে গিয়ে শুল্ক মওকুফের আবদার করতেন তখন তিনি তাদের মনে করিয়ে দিতেন তাদের ছদ্মবেশী জাহাজ ও তাদের সমৃদ্ধ বাণিজ্যের বিষয়ে। তাদের বলতেন, এটি সরকারের হক। বণিকরা অবাক হয়ে শেখ রাশেদের প্রতি সম্মান আরও বাড়িয়ে দিতেন।
আমার বাবা দুবাই ক্রিককে কেন্দ্র করে তার শাসন শুরু করেন। তার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটি ছিল ক্রিকটি সম্প্রসারণ ও গভীর করা। বড় বড় জাহাজের জন্য ক্রিকটিকে খুলে দেওয়া।
আমি খুব ছোটবেলা থেকেই শেখ রাশেদের কাছ থেকে শিখেছি যে একজন নেতা হলেন সবচেয়ে উদ্যমী ব্যক্তি, যিনি প্রকল্পগুলো দক্ষতার সাথে বাস্তবায়নে সর্বাধিক সক্ষম। আমি শেখ রাশেদের কাছ থেকে শিখেছি যে, দুবাইয়ের প্রতিটি দিরহামের একটি মূল্য রয়েছে এবং সঠিক জায়গা ব্যতীত ব্যয় করা উচিত না। শেখ রাশেদ বিন সাইদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত প্রশাসনের সংস্কৃতি হলো, বুদ্ধিমত্তার সাথে অর্থ ব্যয় করা এবং সরকারি অপচয় এড়ানো।
দুবাইয়ের আধিপত্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রহস্যগুলোর মধ্যে একটি হলো, শেখ রাশেদ সরকার ব্যবস্থায় যে মূল্যবোধ তৈরি করেছিলেন তা। প্রকৃতপক্ষে সুশাসন দেশ ও জনগণের কল্যাণ বয়ে আনে।
এনএফ