বিজয়ী হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর কর আরোপ করবেন বলে নির্বাচনী প্রচারণার সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বজুড়ে ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের মালিক ও অর্থনীতিবিদরা এই বিষয়ে ট্রাম্প কতটা ‘সিরিয়াস’ তা বোঝার চেষ্টা করছেন।

অতীতে বিভিন্ন দেশ (যেমন চীন) অথবা নির্দিষ্ট শিল্পখাতকে—উদাহরণ হিসেবে ইস্পাত শিল্প খাতের কথা বলা যায়—লক্ষ্যবস্তু করেছেন ট্রাম্প। কিন্তু এবার নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি সব ধরনের বিদেশি পণ্যের ওপর ১০ থেকে ২০ শতাংশ কর আরোপের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা সব পণ্যে যদি তিনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কর আরোপ করেন, তাহলে বিশ্বজুড়ে এসব পণ্যের দামের ওপর প্রভাব পড়বে।

গত মাসে তিনি কেবল ইউরোপকে নিয়ে কথা বলেছিলেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, ‘‘ইউরোপীয় ইউনিয়ন দারুণ, এটা অনেক সুন্দর শোনাচ্ছে, তাই না? ইউরোপীয় সব ছোট দেশ যারা ঐক্যবদ্ধ... তারা আমাদের গাড়ি নেয় না। তারা আমাদের খামারের পণ্য নেয় না।’’

‘‘তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লাখ লাখ গাড়ি বিক্রি করে। না, না, না, তাদের চড়া মূল্য দিতে হবে।’’

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় নিশ্চিত হওয়ার সাথে সাথেই বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ ও ভক্সওয়াগনের শেয়ার ৫ থেকে সাত শতাংশ পতন ঘটেছে। ইউরোপের দেশ জার্মানির গাড়ি নির্মাতা এসব প্রতিষ্ঠানের একক বৃহত্তম রপ্তানি বাজার হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

নির্বাচনী প্রচারণার সময় ট্রাম্প বলেছিলেন, চীনের লাগাম টানা আর অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধসহ অসংখ্য সমস্যার সমাধান হলো শুল্ক। তিনি বলেন, অভিধানের সবচেয়ে সুন্দর শব্দ শুল্ক।

বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র শুল্ক। আর ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্টভাবে এই অস্ত্রকে ব্যবহার করতে চান। যদিও তার এই মন্তব্য ও কাজের বেশিরভাগই চীনকে লক্ষ্য করে দেওয়া। তবে এটি এখানেই সীমাবদ্ধ নয়।

ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আগাম-প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপের তালিকা তৈরি করছে। ইইউর মন্ত্রীরা অতীতে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের বিষয়ে দেওয়া হুমকিকে যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে না নেওয়ায় তার ফল ভুগতে হয়েছিল ইউরোপকে।

বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি-৭ এর মন্ত্রী গত সপ্তাহে বিবিসিকে বলেছিলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন আমেরিকাকে বিশ্ব অর্থনীতিতে মিত্রদের প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবেন তারা। কারণ তারা বাণিজ্য যুদ্ধের শুরু চান না।

তবে যদি ‘‘অত্যন্ত শক্তিশালী বিস্তৃত শক্তি ব্যবহার করা হয়’’ তাহলে ইউরোপ দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখানোর বিষয়টি বিবেচনা করবে। অতীতে স্টিল এবং অ্যালুমিনিয়ামের ওপর মার্কিন শুল্ক আরোপের প্রতিক্রিয়ায় হার্লে ডেভিডসন মোটরসাইকেল, বোরবন হুইস্কি এবং লেভিস জিন্সের মতো আমেরিকান বিখ্যাত সব পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপ করেছিল ইইউ।

ইউরোজোনের শীর্ষ এক কেন্দ্রীয় ব্যাংকার বিবিসিকে বলেছেন, মার্কিন শুল্ক কেবল ইউরোপে মুদ্রাস্ফীতিমূলক নয়, বরং এটি ইউরোপের প্রতিক্রিয়া কী হবে তার ওপর নির্ভর করছে। গত মাসে আইএমএফ জানিয়েছিল, একটি বড় ধরনের বাণিজ্য যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতির ৭ শতাংশ কিংবা ফরাসি ও জার্মান অর্থনীতির আকারের মতো ক্ষতি করতে পারে। নিশ্চিত না হলেও ট্রান্সআটলান্টিক বাণিজ্য যুদ্ধের ক্ষেত্রে ব্রেক্সিট-পরবর্তী যুক্তরাজ্যের ঠিক কোথায় নিজেকে বসানো উচিত সে সম্পর্কে যুক্তরাজ্য সরকারের কাছে খুব বড় প্রশ্ন রয়েছে।

যুক্তরাজ্যের জন্য এখন পর্যন্ত ভ্রমণের দিকনির্দেশনাটি ছিল খাদ্য ও খামারের মান-সহ ইইউয়ের কাছাকাছি যাওয়া। তবে এটিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যুক্তরাজ্যের একটি ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য চুক্তিকে অত্যন্ত কঠিন করে তুলবে।

জো বাইডেনের প্রশাসন এমন এক চুক্তিতে আগ্রহী ছিল না। এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের অত্যন্ত প্রভাবশালী শীর্ষ বাণিজ্য আলোচক হিসেবে মনে করা হয় বব লাইথাইজারকে। তিনি বলেছেন, নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্যকে সহায়তা করার জন্য যুক্তরাজ্য ইইউর কাছাকাছি থাকবে বলে মনে করা হলেও সেটি চুক্তিতে বাধা তৈরি করেছে। বব লাইথাইজার বলেন, তারা আপনার কাছে আমাদের চেয়ে অনেক বড় বাণিজ্য অংশীদার।

এক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য চেষ্টা করতে পারে এবং নিরপেক্ষ অবস্থানেও থাকতে পারে। কিন্তু সাংঘর্ষিক অবস্থান এড়ানোর জন্য যুক্তরাজ্যকে রীতিমতো চড়াই-উতরাই পোহাতে হবে—বিশেষ করে ওষুধ ও গাড়ির ব্যবসার জন্য।

যুক্তরাজ্যের সরকারের ভাষ্য থেকে বোঝা যায়, তারা বিশ্ব বাণিজ্য যুদ্ধে শান্তি স্থাপনকারী হওয়ার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু কেউ কি তাদের কথা শুনবে? এমন পরিস্থিতি তৈরি হলে ব্রিটেন একটি পক্ষ বেছে নিতে এবং ট্রাম্পের শুল্ক থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা করতে পারে।

বন্ধুত্বপূর্ণ মিত্ররা আরও ভালো চুক্তি পেতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাস্তববাদী অর্থনৈতিক উপদেষ্টারা কূটনীতিকদের খুশি করতে পারেন। আবার সেটা না করে যদি এই ধরনের বাণিজ্য শুল্ক প্রয়োগ বন্ধ করার জন্য যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেওয়া প্রচেষ্টায় অংশ নেয় তাহলে বিশ্ব কি বেশি উপকৃত হবে? এছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দূরে থাকা বাকি বিশ্বের ক্ষেত্রে কী হবে?

বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্র যদি গণ সুরক্ষাবাদের আশ্রয় নেয়, তখন ছোট অর্থনীতির অনেক দেশকে একই কাজ না করা থেকে বিরত রাখতে রাজি করানো কঠিন হয়ে যাবে। নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সতর্ক বার্তাকে গুরুত্বের সাথে নেওয়া উচিত। যদিও এখন পর্যন্ত কোনোকিছুই নিশ্চিত হয়। তারপরও এভাবে অত্যন্ত গুরুতর বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হতে পারে।

সূত্র: বিবিসি।
 
এসএস